কাশীরাম দাস জীবনী – Kasiram Das Biography in Bengali

কাশীরাম দাস জীবনী: আজ আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছি মহান ব্যক্তিদের জীবনী সমগ্র। মহান ব্যক্তি আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা। তাঁদের জীবনের ক্ষুদ্রতম অংশগুলি আমাদের জন্য শিক্ষামূলক হতে পারে। বর্তমানে আমরা এই মহান ব্যক্তিদের ভুলতে বসেছি। যাঁরা যুগ যুগ ধরে তাদের কর্ম ও খ্যাতির মধ্য দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন এবং জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প ও সাহিত্যের জগতে এক অনন্য অবদান রেখেছেন এবং তাঁদের শ্রেষ্ঠ গুণাবলী, চরিত্র দ্বারা দেশ ও জাতির গৌরব বৃদ্ধি করেছেন। সেইসব মহান ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম কাশীরাম দাস জীবনী -এর সমগ্র জীবনী সম্পর্কে এখানে জানব।

কাশীরাম দাস জীবনী – Kasiram Das Biography in Bengali

নামকাশীরাম দাস
জন্মপ্রায় ১৬০০ খ্রিঃ
পিতাকমলাকান্ত
পেশাঔপন্যাসিক
উল্লেখযোগ্য কর্মমহাভারত, সত্যনারায়ণের পুঁথি, স্বপ্নপর্ব, জলপর্ব ও নলোপাখ্যান।
মৃত্যুপ্রায় ১৬৫০ খ্রিঃ

মহাভারতের কথা অমৃত সমান।

কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।

এই পরিচিত ভণিতা প্রায় তিনশ বছর ধরে বাংলার আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হয়ে চলেছে।

ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ মহাকাব্য মহাভারত। এটি কেবল পুণ্যকাহিনী মাত্র নয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের আকর স্বরূপ। ভারত তথা মানবজাতির সর্বজনীন বিধি নীতির আধার।

প্রাচীন ভারতের বেদ উপনিষদ সহ সমস্ত পুরাণের সার হল মহাভারত মহাগ্রন্থ। তাই তাকে বলা হয় পঞ্চম বেদ। আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত দেব-দেবী, যোগী, গৃহী, রাজা, প্রজা, পাপী, পুণ্যবান, দৈত্য-দানব, যক্ষ-রাক্ষস, পিশাচ, মাতঙ্গ, ভুজঙ্গ, কুরঙ্গ, পর্বত, জঙ্গম, সমুদ্র প্রভৃতি, এককথায় বিশ্বের সমস্ত জীবের ইতিহাস স্বরূপ এই গ্রন্থ।

যাট লক্ষ শ্লোকে মহাভারত প্রথম রচনা করেন মহামুনি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস। এই ষাট লক্ষ শ্লোকের মধ্যে ত্রিশ লক্ষ দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে চৌদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং বাকি লক্ষ শ্লোক মর্তলোকে প্রচারিত হয়েছিল। এই লক্ষ শ্লোক পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের প্রাজ্ঞ পন্ডিতমন্ডলী মূল সংস্কৃত থেকে বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করেন।

আরও পড়ুন- মহর্ষি বাল্মীকি জীবনী

বাংলা ভাষায় যে অনুবাদটি সর্বজন প্রিয় ও বহুল প্রচলিত তা রচনা করেছিলেন কাশীরাম দাস। তার আগে আরও অনেক কবি মহাভারতের বঙ্গানুবাদ করেছিলেন, কিন্তু কালজয়ী হয়েছেন কাশীরাম দাস নিঃসন্দেহে।

কাশীরামের পূর্ববর্তী অনুবাদকগণ পান্ডিত্যপূর্ণ ভাষায় মূল গ্রন্থের আক্ষরিক অনুবাদ করেছিলেন। ভক্তি ও ভাব তাঁদের চিন্তাকে সঞ্জীবিত করেনি।

কাশীরামের সঙ্গে এখানেই এই সকল কবিদের রচনার প্রভেদ। তিনি কেবল অনুবাদ করেই ক্ষান্ত হননি। নিজের অর্ন্তর্নিহিত ভাব ও ভক্তিধারায় তাঁর রচনাকে পুষ্ট করেছিলেন।

সরল, প্রাঞ্জল অথচ সুন্দর সরস ভাষায় পয়ার ছন্দে রচিত কাশীরাম দাসের মহাভারত যুগের পর যুগ বাংলার গ্রামে গঞ্জে, নগরে, বন্দরে ভক্ত ও রসিক নরনারীর কণ্ঠে ঝঙ্কৃত হয়ে চলেছে। পুণ্যশ্লোক কাশীরাম দাসের জীবনকাহিনী আজ পর্যন্ত সম্পূর্ণ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

তিনি নিজের রচনায় যেটুকু আত্মপরিচয় প্রকাশ করেছেন, তাই আমাদের সম্বল।

কবি লিখেছেন,

ইন্দ্রানী নামেতে দেশ পূর্ব্বাপর স্থিতি।

দ্বাদশ তীৰ্থেতে যথা বৈসে ভাগীরথী।।

কায়স্থ-কুলেতে জন্ম বাস সিদ্ধিগ্রাম।

প্রিয়ঙ্কর দাসসুত সুধাকর নাম।।

তৎপুত্র কমলাকান্ত কৃষ্ণদাস পিতা।

কৃষ্ণদাসানুজ গদাধর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা।।

এই পাঠ থেকে জানা যায় ইন্দ্রানী পরগনার অন্তর্গত সিদ্ধি নামক গ্রাম কবির জন্মস্থান। তাঁর বাসস্থান ছিল ভাগীরথীর কূলে আর সেখানে বারটি তীর্থ অবস্থিত ছিল।

আরও পড়ুন- মহাকবি কালিদাস জীবনী

বিশেষ অনুসন্ধানে জানা যায়, বর্ধমান কাটোয়ার অন্তর্গত ইন্দ্রাণী নামক পরগনায় প্রাচীনকালে সিদ্ধিগ্রাম অবস্থিত ছিল। এই গ্রামের কাছেই গঙ্গার কূলে বারটি তীর্থ অর্থাৎ ঘাটের ধ্বংসাবশেষ এখনও বর্তমান।

কাশীরামের কৌলিক উপাধি ছিল দেব। কিন্তু দেব দ্বিজে ভক্তি শ্রদ্ধা প্রকাশের জন্য তিনি নিজেকে ‘দাস’ যুক্ত করে বিনয় নম্রতা প্রকাশ করেছেন।

মহাভারতে নিজ রচনার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তিনি দাস শব্দ প্রয়োগ করেছেন। কাশীরামের প্রপিতামহের নাম ছিল প্রিয়ঙ্কর। পিতামহের নাম সুধাকর এবং পিতার নাম কমলাকান্ত। কাশীরাম ছিলেন পিতার মধ্যম পুত্র। তাঁর অগ্রজের নাম কৃষ্ণদাস ও কনিষ্ঠের নাম-গদাধর উত্তরাধিকার সূত্রেই কমলাকান্তের পুত্রগণ কবি প্রতিভার অধিকারী হয়েছিলেন।

আরও পড়ুন- কৃত্তিবাস ওঝা জীবনী

জ্যেষ্ঠ কৃষ্ণদাস ভাগবতের বঙ্গানুবাদ করে শ্রীকৃষ্ণবিলাস কাব্য রচনা করেন। কনিষ্ঠপুত্র গদাধর জগন্নাথ মঙ্গল কাব্যের রচয়িতা। কাশীরাম মহাভারতের আদি, সভা, বন ও বিরাট পর্ব পর্যন্ত রচনা করেছিলেন বলে জানা যায়।

ইতিমধ্যেই তাঁর অকালমৃত্যু ঘটলে মহাভারতের অবশিষ্ট পর্বের অনুবাদ করে যেতে পারেননি। গদাধরের পুত্র নন্দরামকে অন্তিম সময় তিনি তাঁর আরব্ধ কাজ সম্পূর্ণ করার আদেশ কবে যান। জ্যেষ্ঠতাতের আদেশে নন্দরাম মহাভারতের অনুবাদ সম্পূর্ণ করেন। কাশীরামের মহাভারতের প্রথম চার পর্ব সর্বপ্রথম শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে ১৮০১-০৩ খ্রিঃ ছাপা হয়। ১৮৩৬ খ্রিঃ এই প্রেস থেকেই জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের সম্পাদনায় মহাভারতের সম্পূর্ণ সংস্করণ প্রকাশিত হয়।

কাশীরামের বাসস্থান সিদ্ধিগ্রাম বর্তমানে সিঙ্গিগ্রাম নামে পরিচিত। অনুমান করা হয় সিদ্ধিগ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রামের জমিদার এই গ্রাম নিজ গ্রামের সঙ্গে যুক্ত করায় সিদ্ধিগ্রাম নামটি লোপ পায়।

আরও পড়ুন- মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস জীবনী

অনেকের মতে দাইহাটের নিকট সিদ্ধিগ্রাম অঞ্চলেই কবির পৈতৃক ভিটা বর্তমান ছিল। কবি কাশীরামদাস মেদিনীপুর জেলার আবাসগড়ের রাজার আশ্রয়ে একটি পাঠশালা স্থাপন করে শিক্ষকতা করতেন।

প্রায়ই রাজবাড়িতে কথক-গায়কদের সেই সময় আগমন ঘটত এবং তাঁরা মহাভারত পুরাণাদি পাঠ করতেন। কথকদের মুখে কথকতা শুনেই কবির মনে বাংলা ভাষায় মহাভারত রচনার আগ্রহ জন্মে। পরবর্তী কালে তাঁর রচিত মহাভারতই কালোত্তীর্ণ হয়ে বাঙালীর ঘরে ঘরে স্থান লাভ করে।

কাশীরামের জীবনের যেটুকু তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে তা থেকে জানা যায়, কবি নিজ গ্রামে অপর সকলের উপকারের কথা চিন্তা করে একটি পুকুর খনন করান। সেই পুকুর এখনো বর্তমান, কেশেপুকুর নামে তার পরিচিতি। কবির বাস্তুভিটা তাঁর পুত্র ১০৮৫ খ্রিঃ তাঁদের কুলপুরোহিতকে দান করেন।

এই দানপত্র থেকে অনুমান করা হয় কাশীরাম ১০০০ খ্রিঃ কিছুকাল পরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কাশীরামের রচিত অপর গ্রন্থগুলো হল, সত্যনারায়ণের পুঁথি, স্বপ্নপর্ব, জলপর্ব ও নলোপাখ্যান।

Leave a Comment