কৃত্তিবাস ওঝা জীবনী – Biography of Krittivas Ojha in Bengali

কৃত্তিবাস ওঝা জীবনী – Biography of Krittivas Ojha in Bengali: আজ আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছি মহান ব্যক্তিদের জীবনী সমগ্র। মহান ব্যক্তি আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা। তাঁদের জীবনের ক্ষুদ্রতম অংশগুলি আমাদের জন্য শিক্ষামূলক হতে পারে। বর্তমানে আমরা এই মহান ব্যক্তিদের ভুলতে বসেছি। যাঁরা যুগ যুগ ধরে তাদের কর্ম ও খ্যাতির মধ্য দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন এবং জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প ও সাহিত্যের জগতে এক অনন্য অবদান রেখেছেন এবং তাঁদের শ্রেষ্ঠ গুণাবলী, চরিত্র দ্বারা দেশ ও জাতির গৌরব বৃদ্ধি করেছেন। সেইসব মহান ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম বাংলার আদি কবি কৃত্তিবাস ওঝা জীবনী -এর সমগ্র জীবনী সম্পর্কে এখানে জানব।

কৃত্তিবাস ওঝা জীবনী – Biography of Krittivas Ojha in Bengali

নামকৃত্তিবাস মুখোপাধ্যায়
জন্মআনুমানিক ১৩৮১ খ্রিস্টাব্দ ফুলিয়া, নদিয়া জেলা, পশ্চিমবঙ্গ
জাতীয়তাভারতীয়
পেশাকবি
ভাষাবাংলা
ধরনকবিতা
সাহিত্য আন্দোলনমধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্য
উল্লেখযোগ্য রচনাবলিকৃত্তিবাসী রামায়ণ, শ্রীরাম পাঁচালি
মৃত্যুআনুমানিক ১৪৬১ খ্রিস্টাব্দ (বয়স ৭৯–৮০)

বাংলার আদি কবি কৃত্তিবাস রচিত রামায়ণ এমন একটি অসাধারণ গ্রন্থ যা দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী ধরে কি গরীবের ঝুপরিতে কি ধনীর প্রাসাদে সর্বত্র সমান মর্যাদায় পঠিত হয়ে আসছে। জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে কবি কৃত্তিবাসের তুলনা একমাত্র তিনিই।

বাল্মীকি রচিত রামায়ণের আক্ষরিক অনুবাদ তিনি করেননি। রামকাহিনীতে সংযোজিত করেছেন নিজের কল্পিত এমন অনেক বিষয় যা রামায়ণকে আধুনিক মন ও মননের উপযোগী করে তুলেছে। এই গ্রন্থই বাঙালীর ঘরে ঘরে রামের মহৎ জীবন প্রচার করে চলেছে।

আপামর মানুষের মধ্যে কবি কৃত্তিবাসের এমন আশ্চর্য সমাদর লক্ষ্য করে একদিন বাংলার অপর এক কবি মাইকেল মধুসূদন এমনি একজন সার্থক কবি হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন।

যাঁর রচনা, চণ্ডীমণ্ডপে, বটতলায়, মুদিখানায় পঠিত হবে আবার সমান আগ্রহে ও যত্নে ধনীর প্রাসাদেও ধ্বনিত হবে।

কবি কৃত্তিবাসের সঠিক জন্ম তারিখ পাওয়া যায়নি। এমনকি তাঁর রচিত মূল পাণ্ডুলিপিও আজ পর্যন্ত আবিষ্কার করা সম্ভব হয় নি। প্রাচীন কবিরা প্রচলিত প্রথা অনুসারে নিজের রচনার ভণিতাতে জন্মসাল বা সময় উল্লেখ করতেন। কৃত্তিবাসের রচনায় তা অনুপস্থিত।

তিনি আত্মপরিচয় হিসাবে যা বিবৃত করেছেন তা থেকে কেবল কবির জন্মদিনটির উল্লেখ পাওয়া যায়।

সেটি এই রকম:

আশ্চর্যের বিষয় যে কবি রচিত এই আত্মকাহিনীটিও কালের কবলে হারিয়ে যেতে বসেছিল। সুবিখ্যাত সমালোচকরায়বাহাদুর দীনেশচন্দ্র সেন ও হীরেন্দ্রনাথ দত্ত এটি উদ্ধার করতে সমর্থ হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে অপর একটি পুঁথি থেকেও কবির আত্মকাহিনী উদ্ধার করেছিলেন ডঃ নলিনীকান্ত ভট্টশালী।

কবি কখন বর্তমান ছিলেন সেই কাল নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এই আত্মকাহিনীই হল মূল আকর। এর সহায়তায় আজ আমরা বলতে পারছি বঙ্গভারতীর বরপুত্র বঙ্গদেশে কখন কোন স্থানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আত্মকাহিনীতে কবি জানিয়েছেন, আদিত্যবার শ্রীপঞ্চমী পুণ্য মাঘমাসে তাঁর জন্ম হয়েছিল। পুঁথিটি যারা নকল করেছিলেন, তাঁদের বিভ্রান্তির জন্য কোথাও কোথাও পুণ্য শব্দটি পূর্ণ রূপে লেখা হয়েছে।

ফলে এ নিয়েও গবেষকদের মধ্যে যথেষ্ট বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। যাইহোক দীনেশচন্দ্র সেনই প্রথম জানিয়েছিলেন কবির জন্ম হয়েছিল ১৪৪০ খ্রিঃ। জন্মদিনটি মাঘমাসের শ্রীপঞ্চমী তিথি রবিবার।

এই হিসেব অনুযায়ী কবির জন্মস্থান ফুলিয়া গ্রামে স্মৃতিফলক প্রোথিত হয়েছে। অবশ্য পরবর্তীকালে ঐতিহাসিক ও ভাষাবিদগণ অনেকেই এই কালটির সঙ্গে একমত হতে পারেন নি।

বর্তমান গবেষকগণ Indian Ephemeries -এর সাহায্যে সঠিক সালটি নিরূপণ করেছেন রবিবার এবং শ্রীপঞ্চমী তিথিকে ধ্রুব করে। এই হিসাবে কবি কৃত্তিবাসের জন্ম হয়েছিল ১৪৪৩ খ্রিঃ ৬ ই জানুয়ারী।

জন্ম সাল-তারিখ জানা সম্ভব হলেও মৃত্যুর সাল-তারিখ জানা সম্ভব হয় নি। জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল কাব্যের সূত্র ধরে জানা যায়, কবি কৃত্তিবাস চৈতন্যদেবের জন্মের পূর্ব পর্যন্ত ১৪৯৩ খ্রিঃ অবধি জীবিত ছিলেন।

কবির আত্মকাহিনী থেকে জানা যায়, তাঁরা ছিলেন মুখটি বংশের কুলীন এবং পূর্বতন পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশের অধিবাসী।

সেই দেশে আকাল উপস্থিত হলে কবির বৃদ্ধ প্রপিতামহ পন্ডিত নরসিংহ ওঝা সপরিবারে পশ্চিমবঙ্গে গঙ্গাতীরে এক গ্রামে চলে আসেন। পূর্বে মাঝিরা এই গ্রামে নিজেদের বাসস্থানে মনোরম ফুলবাগান তৈরি করত।

তাই গ্রামের নাম হয়েছিল ফুলিয়া। এই গ্রামের দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে গঙ্গা প্রবাহিত। এখানেই নরসিংহ ওঝা পুত্রপৌত্রাদি নিয়ে বাস করতে থাকেন। নরসিংহের পুত্র গর্ভেশ্বর।

গর্ভেশ্বরের তিন পুত্র মুরারি, সূর্য ও গোবিন্দ। মুরারির সাত পুত্র। তার মধ্যে জ্যেষ্ঠ পুত্র ভৈরব রাজসভায় সমাদৃত হয়েছিলেন। অপর পুত্র বনমালী। তাঁর ছয় পুত্র এক কন্যা। কৃত্তিবাস বনমালীর জ্যেষ্ঠপুত্র। কৃত্তিবাসের মায়ের নাম মালিনী।

অবশ্য বিভিন্ন পুঁথিতে কবির মায়ের নাম বিভিন্ন দেখা যায়। যেমন, মেনকা, মানিকী, মানিকি, মালিকা ইত্যাদি। কবি প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন পিতা ও পিতামহের কাছেই। বারবছর বয়সে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য তাঁকে পাঠানো হয় (১৪৫৪ খ্রিঃ ৪ ই জানুয়ারী) গৌড়ের বিখ্যাত পন্ডিত রায়মুকুট আচার্য চূড়ামণি বৃহস্পতি মিশ্রের কাছে।

এরপর তিনি যান উত্তরবঙ্গে আচার্য দিবাকরের কাছে। পাঠ শেষ হলে আচার্য দিবাকর সর্বসাধারণের জন্য বঙ্গভাষায় রামায়ণ গান বা পাঁচালী বচনার আদেশ করেন। শিক্ষাগুরুর আদেশে কৃত্তিবাস রামায়ণ পাঁচালী রচনা শুরু করেন।

বাইশ বছর বয়সে বাড়ি ফিরে এসে তিনি তৎকালীন গৌড়ের অধিপতি রুকনুদ্দীন বারবাক শাহের দরবারে উপস্থিত হন এবং সাতটি শ্লোক রচনা করে তাঁকে সম্মান প্রদর্শন করেন। কৃত্তিবাসের কবিত্বে সন্তুষ্ট হয়ে গৌড়াধিপতি তাঁকে রাজকীয় মর্যাদায় ভূষিত করতে ইচ্ছা প্রকাশ করলে তিনি সগর্বে জানান:

কারো কিছু নাই লই করি পরিহার।

যথা যাই তথায় গৌরব মাত্র সার।।

তবে রাজসম্মান সসম্মানে প্রত্যাখ্যান করলেও তিনি জনগণদ্বারা ফুলিয়ার কবি হিসাবে সংবর্ধিত হয়েছিলেন।

বিভিন্ন পুঁথি থেকে জানা যায় রামায়ণ গান রচনায় কবি গৌড়েশ্বরের আন্তরিক সমর্থন পেয়েছিলেন।

তৎকালীন সমাজের কৌলিন্য প্রথা অনুযায়ী কবি তিনবার বিবাহ করেছিলেন। তাঁর এক পুত্র ও চার কন্যা লাভ হয়েছিল।

বর্তমানে কৃত্তিবাসী রামায়ণ নামে যেটি প্রচলিত তার সপ্তকান্ডের অনেকখানিই সংগ্রহ করেছিলেন ন্যাথানিয়াল ব্রাসি হ্যালহেড। গ্রন্থাকারে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৮০৩ খ্রিঃ শ্রীরামপুর মিশন থেকে।

আরও পড়ুন-

Leave a Comment