সাধক কবি রামপ্রসাদ জীবনী – Biography of Sadhak Kavi Ramprasad in Bengali

সাধক কবি রামপ্রসাদ জীবনী – Biography Of Sadhak Kavi Ramprasad In Bengali: আজ আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছি মহান ব্যক্তিদের জীবনী সমগ্র। মহান ব্যক্তি আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা। তাঁদের জীবনের ক্ষুদ্রতম অংশগুলি আমাদের জন্য শিক্ষামূলক হতে পারে। বর্তমানে আমরা এই মহান ব্যক্তিদের ভুলতে বসেছি। যাঁরা যুগ যুগ ধরে তাদের কর্ম ও খ্যাতির মধ্য দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন এবং জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প ও সাহিত্যের জগতে এক অনন্য অবদান রেখেছেন এবং তাঁদের শ্রেষ্ঠ গুণাবলী, চরিত্র দ্বারা দেশ ও জাতির গৌরব বৃদ্ধি করেছেন। সেইসব মহান ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম সাধক কবি রামপ্রসাদ -এর সমগ্র জীবনী সম্পর্কে এখানে জানব।

সাধক কবি রামপ্রসাদ জীবনী – Biography of Sadhak Kavi Ramprasad in Bengali

নামরামপ্রসাদ সেন
জন্ম১৭২০ খ্রিঃ হালিশহর, সুবা বাংলা, মুঘল সাম্রাজ্য (অধুনা উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত)
পেশাসভাকবি
অন্যান্য নাম“কবিরঞ্জন”
মৃত্যু১৭৮৬ খ্রিঃ হালিশহর, বাংলা প্রদেশ, ব্রিটিশ ভারত (অধুনা উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত)

সাধক কবি রামপ্রসাদ সম্বন্ধে যিনি সর্বপ্রথম অনুসন্ধান ও গবেষণায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন তিনি বাংলার আর এক সুখ্যাত কবি ঈশ্বর গুপ্ত। তিনি লিখেছিলেন, বঙ্গদেশের মধ্যে যে কয়জন মহাশয় কবিরূপে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন তন্মধ্যে রামপ্রসাদকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলিয়াই গণ্য করিতে হইবে, কারণ, তিনি সকল রসের রসিক, প্রেমিক, ভাবুক ও ভক্ত এবং জ্ঞানী ছিলেন।

প্রাচীন বাংলার কবি রামপ্রসাদ সম্পর্কে কবি ঈশ্বর গুপ্তের সংগৃহীত এবং গবেষণালব্ধ তথ্যই এখনো পর্যন্ত পন্ডিত-গবেষক মহলে স্বীকৃত।

রামপ্রসাদী সংগীতের জনপ্রিয়তা গত তিনশ বছরে এতটুকু কমেনি। বরং ভক্ত, সাধক, ভাবুক, তত্ত্বজিজ্ঞাসু ও কাব্যরসিকের আগ্রহ ও সমাদর উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করে চলেছে। রামপ্রসাদের মাতৃসঙ্গীতে কে না আবিষ্ট হয়।

রাম প্রসাদ সেনের (Ram Prasad Sen) জন্ম স্থান ও পিতামাতা: Birth Place And Parents of Ramprasad Sen

অথচ এই সর্বজনপ্রিয় কবির জীবন সম্পর্কে প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যায় খুবই কম। নানা গল্প কিংবদন্তিতে ভরা তাঁর জীবনকাহিনী। রামপ্রসাদের জন্মের সঠিক সন তারিখ নিয়ে বিতর্কের অবসান ঘটিয়েছেন ডঃ দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য। তিনি কবির জন্মকালীন গ্রহসংস্থান ধরে হিসেব করে অনুমান করেছেন তাঁর জন্মমাস আশ্বিন, সন ১১২৭ (১৭২০ খ্রিঃ)। ঈশ্বর গুপ্তও মোটামুটি ১৭২০ খ্রিঃ-ই সিদ্ধান্ত করেছেন।

আরও পড়ুন- মহাকবি কালিদাস জীবনী

চব্বিশ পরগনা জেলার হালিশহরের অন্তর্গত ভাগীরথী তীরে অবস্থিত কুমারহট্ট গ্রাম। এখানেই রামপ্রসাদের আবির্ভাব হয়। তাঁর কৌলিক নাম রামপ্রসাদ সেন।

পিতার নাম রামরাম সেন। রামপ্রসাদ একাধারে শক্তিসাধক, কবি ও গায়ক। তাঁর রচিত গানের গীত-ভঙ্গীই রামপ্রসাদী সুর নামে খ্যাত। তাঁর রচিত ভক্তিগীতি বঙ্গসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।

রাম প্রসাদ সেনের (Ram Prasad Sen) প্রথম জীবন: Ramprasad Sen’s Early Life

লোকগীতি ও পল্লীগীতির মতই তাঁর নিজস্ব সুরে গাওয়া গীত বহুযুগ পূর্ব থেকে শোনা যায় বাংলার পথে ঘাটে, অরণ্যে প্রান্তরে। চাষী হল চালনা করছে, মাঝি নৌকায় দাঁড় বাইছে, উদাসী পথিক পথ চলছে, সকলেরই কণ্ঠে ধ্বনিত হয় রামপ্রসাদের গান।

অল্প বয়সেই রামপ্রসাদ বাংলা, সংস্কৃত, ফারসী ও হিন্দী ভাষায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। শিক্ষানুরাগের পাশাপাশি তাঁর মধ্যে উপ্ত ছিল শক্তিতত্ত্বের বীজ। শক্তিরূপিনী মায়ের নামে বিভোর থাকেন তিনি দিবানিশি।

আরও পড়ুন- কৃত্তিবাস ওঝা জীবনী

পিতার মৃত্যুর পরে সংসারে দেখা দেয় অনটন। তখন বড় দুঃখে তিনি গাইলেন, এ সংসারে এনে মাগো করলি আমায় লোহা-পেটা। তবু আমি কালী বলে ডাকি সাবাস আমার বুকের পাটা। ঈশ্বর ভক্তি আর কবিশক্তি জন্মগত ভাবেই পেয়েছিলেন রামপ্রসাদ। কিন্তু তা দিয়ে তো গ্রাসাচ্ছাদন চলে না, বাধ্য হয়ে তাঁকে গরানহাটার জমিদার দুর্গাচরণ মিত্রের সেরেস্তায় মুহুরীর কাজ নিতে হল।

রাম প্রসাদ সেনের বিবাহ জীবন ও পরিবার: Ramprasad Sen’s Marriage Life And Family

রামপ্রসাদ চলে এলেন কলকাতায়। কিন্তু সেরেস্তার হিসেবের খাতায় শ্যামাবিষয়ক গীতরচনা করে লিখে রাখতেন। ম্যানেজারের কাছে নালিশ শুনে দুর্গাচরণ তলব করেন হিসেবের খাতা। দেখেন জমা-খরচের পরিবর্তে লেখা শুধু গান- মাতৃসঙ্গীত।

গানগুলির অন্তর্নিহিত ভাব অভিভূত করে দুর্গাচরণকে। তিনি মাসিক তিনটাকা বৃত্তির ব্যবস্থা করে রামপ্রসাদকে পাঠিয়ে দিলেন স্বগ্রামে। সহৃদয় মনিবের বদান্যতায় এভাবে সংসারচিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে রামপ্রসাদ ভগবৎ সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন।

সংসার সামলান স্ত্রী সর্বানী দেবী, রামপ্রসাদ গঙ্গাতীরে বসে প্রাণ-আকুল করা সুরে গান করেন। ভক্তিবাদী রামপ্রসাদের গানের সহজ সরল কথায় ব্যক্ত হয় প্রাণের আর্তি, গূঢ় ঈশ্বর-তত্ত্বের সহজ প্রতীকী- রূপ।

সেই গান শুনে গঙ্গাবক্ষে নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বজরা থেমে যায়। বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার চোখে জল আসে। মুগ্ধ কৃষ্ণচন্দ্র শ্রদ্ধা ভক্তির নিদর্শন স্বরূপ সাধক-কবিকে দান করেন একান্ন বিঘা নিষ্কর জমি। বাড়ির উঠোনে একবার বেড়া বাঁধছিলেন রামপ্রসাদ।

আরও পড়ুন- মহর্ষি বাল্মীকি জীবনী

মেয়ে জগদীশ্বরীকে বলেছেন বেড়ার অপর দিক থেকে খুঁটির দড়িটা বাড়িয়ে দিতে। ছেলেমানুষ জগদীশ্বরী পিতার আদেশ ভুলে মায়ের সঙ্গে সংসারের কাজে চলে গেছে। এদিকে রামপ্রসাদ শ্যামামায়ের গান ধরেছেন আর বেড়া বাঁধছেন।

একসময় সুষ্ঠুভাবেই বেড়া বাঁধার কাজ শেষ করেন তিনি। বেড়ার দড়ি ফেরানোর কথা যখন মনে পড়ল জগদীশ্বরী ছুটে এলেন বাবার কাছে।

এসে দেখেন বাবার বেড়া বাঁধা শেষ হয়ে গেছে। দুজনেই আশ্চর্য! দুজনের মনেই প্রশ্ন দেখা দেয়। কে সেই মেয়ে, সারা বেলা বেড়ার অপর দিক থেকে রামপ্রসাদকে দড়ি ফিরিয়ে দিয়েছেন?

সাধক বুঝলেন, ব্রহ্মময়ী মা কন্যারূপে এসে এতক্ষণ সন্তানকে সাহায্য করে গেছেন। আকুল হয়ে কেঁদে গেয়ে উঠলেন ভক্ত কবি-

নয়ন থাকতে দেখলে না মন
কেমন তোমার কপাল পোড়া।
মা ভক্তে ছলিতে তনয়া রূপেতে
বেঁধে গেলেন ঘরের বেড়া।

একবার ঘটনাচক্রে রামপ্রসাদ রওনা হয়েছেন কাশীধামে, সেখানে অন্নপূর্ণাকে গান শোনাবেন বলে।

পথ চলতে চলতে শ্রান্ত রামপ্রসাদ ত্রিবেণীতে গঙ্গার ধারে বিশ্রাম করতে বসলেন। নিদ্রায় জড়িয়ে এলো চোখ। এখানে ঘুমে স্বপ্ন দেখলেন, বিশ্বজননী বলছেন তোমাকে কাশী আসতে হবে কেন, আমি যে ভক্তের হৃদয়েই থাকি।

এখানেই শোনাও তোমার মধুর কন্ঠের গান। অত কষ্ট করে অত দূরের পথে নাই বা গেলে প্রসাদ।

জেগে উঠে রামপ্রসাদ গান ধরলেন
আর কাজ কি আমার কাশী।
মায়ের পদতলে পড়ে আছে
গয়া-গঙ্গা-বারানসী।

এখান থেকে ফিরে গিয়েই তন্ত্র সাধনমতে পঞ্চমুন্ডীর আসন পাতলেন রামপ্রসাদ। এখানেই তন্ত্রাচার্য শ্রীকৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ এসে মাতৃমন্ত্রে দীক্ষা দিলেন তাঁকে। গুরুর কৃপাবলে এখানেই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন রামপ্রসাদ।

রাম প্রসাদ সেনের মৃত্যু: Ramprasad Sen’s Death

সিদ্ধিলাভের কিছুকাল পরেই একদিন মরদেহ ত্যাগ করে নিত্যলীলায় প্রবেশ করেন ভক্ত কবি রামপ্রসাদ। বাষট্টি বছর বয়সে, ১৭৮৬ খ্রিঃ। বঙ্গভূমিতে যত কবি জন্মেছেন, তাঁদের মধ্যে রামপ্রসাদই সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় গীতিকাব্য রচনা করে তাতে সুর সংযোজন করেন এবং সঙ্গীতক্ষেত্রে অভিনব এক স্থায়ী সঙ্গীত-রী ও সুরের প্রবর্তন করেন।

রাম প্রসাদ সেনের সম্মান: Ramprasad Sen’s Honors

রামপ্রসাদের কালীকীর্তন ও কৃষ্ণকীর্তন নামে দুটি ছোট কাব্য রয়েছে। এছাড়া মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের অনুরোধে তিনি বিদ্যাসুন্দর কাব্যও রচনা করেছিলেন। তিনি কবিরঞ্জন উপাধি লাভ করেছিলেন।

Leave a Comment