মেঘনাদ সাহা জীবনী – Meghnad Saha Biography in Bengali

মেঘনাদ সাহা জীবনী: আজ আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছি মহান ব্যক্তিদের জীবনী সমগ্র। মহান ব্যক্তি আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা। তাঁদের জীবনের ক্ষুদ্রতম অংশগুলি আমাদের জন্য শিক্ষামূলক হতে পারে। বর্তমানে আমরা এই মহান ব্যক্তিদের ভুলতে বসেছি। যাঁরা যুগ যুগ ধরে তাদের কর্ম ও খ্যাতির মধ্য দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন এবং জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প ও সাহিত্যের জগতে এক অনন্য অবদান রেখেছেন এবং তাঁদের শ্রেষ্ঠ গুণাবলী, চরিত্র দ্বারা দেশ ও জাতির গৌরব বৃদ্ধি করেছেন। সেইসব মহান ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম মেঘনাদ সাহা (Meghnad Saha) -এর সমগ্র জীবনী সম্পর্কে এখানে জানব।

মেঘনাদ সাহা জীবনী – Meghnad Saha Biography in Bengali

নামমেঘনাদ সাহা
জন্ম১৮৯৩ খ্রিঃ ৬ অক্টোবর, বাংলাদেশের ঢাকার শ্যাওড়াতলি গ্রামে
পিতাজগন্নাথ সাহা
মাতাভুবনেশ্বরী সাহা
জাতীয়তাভারতীয়
পেশাবাঙালি তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী
মৃত্যু৬ অক্টোবর ১৮৯৩

মেঘনাদ সাহা ‘র জন্ম: Meghnad Saha’s Birthday

১৮৯৩ খ্রিঃ ৬ অক্টোবর বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকার অদূরে শ্যাওড়াতলি গ্রামে মেঘনাদ সাহার জন্ম। বাবা জগন্নাথ সাহার গ্রামের বাজারে ছিল একটি মুদির দোকান।

সেই দোকানের সামান্য আয়েই কায়ক্লেশে চলত পরিবারের ভরণপোষণ।

মেঘনাদ সাহা ‘র ছোটবেলা: Meghnad Saha’s Childhood

বর্ণপরিচয় শেষ হলে মেঘনাদকে গ্রামের প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হল। বাবার সঙ্গে মুদি দোকানে বসাটাই ছিল প্রধান কাজ। সেই ফাঁকে স্কুলে যাওয়ার সুযোগ করে নিতে হত। ছেলেবেলা থেকেই ছিলেন মেধাবী।

মেঘনাদ সাহা ‘র শিক্ষাজীবন: Meghnad Saha’s Educational Life

তাই যে সামান্য সময়টুকু পড়াশোনার জন্য পেতেন, তাতেই তাঁর স্কুলের পাঠ তৈরি হয়ে যেত। এভাবে দোকানের কাজ আর পড়াশোনার মধ্য দিয়েই প্রাথমিক স্কুলের পাঠ শেষ হল। এরপর ভর্তি হলেন সাত মাইল দূরের শিমুলিয়া গ্রামের মিডল স্কুলে।

প্রতিদিনের যাতায়াতের অসুবিধার জন্য স্কুলের কাছেই এক চিকিৎসকের বাড়িতে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হল।

বিনিময়ে মেঘনাদকে প্রয়োজন মত বাড়ির কাজকর্ম করে দিতে হতো। দিনভর অক্লান্ত পরিশ্রমের পর বেশির ভাগ দিন রাত জেগেই পড়াশোনা করতে হতো তাঁকে।

আরও পড়ুন- আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় জীবনী

ছেলেবেলার এই দুঃখকষ্টের দিনগুলোর স্মৃতি কোনদিনই তিনি ভুলতে পারেননি। মিডল স্কুলের পরীক্ষায় ঢাকা বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে বৃত্তিলাভ করলেন মেঘনাদ। এরপরে ঢাকার কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হলেন। চূড়াস্ত আর্থিক দূরবস্থার মধ্যেই পড়াশোনা করতে হয়েছিল মেঘনাদকে।

তার ভেতরেই দেশের অশান্ত রাজনৈতিক অবস্থার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়তে হয়েছিল তাঁকে।

সেই সময় শুরু হয়েছিল দেশব্যাপী বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের প্রবল জোয়ার। চারদিকে বিক্ষোভ মিছিল প্রতিবাদসভা।

তৎকালীন পূর্ববঙ্গের গভর্নর ছিলেন ফুলার সাহেব। তিনি একদিন এলেন কলেজিয়েট স্কুল পরিদর্শনে। সেই সময়ে অন্য অনেকের সঙ্গে মেঘনাদও গভর্নরকে বিক্ষোভ দেখাবার জন্য খালি পায়ে স্কুলে গিয়েছিলেন। ফল যা হবার তাই হল।

স্কুল থেকে বিতাড়িত হতে হল, স্কলারশিপ বন্ধ হল। দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্র হিসেবে বিনা বেতনে পড়ার যে সুযোগ পেয়েছিলেন, তা থেকেও বঞ্চিত হলেন। অনিবার্যভাবেই যুগের আবর্তে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন মেঘনাদ। কিন্তু অভিভাবকরা তার ভবিষ্যতের কথা ভেবে শঙ্কিত হয়ে পড়লেন।

মেঘনাদকে স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে সরিয়ে নেবার জন্য তাঁর দাদা জয়নাথ তাঁকে বেসরকারি কিশোরীলাল জুবিলী স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। এই স্কুল থেকেই কৃতিত্বের সঙ্গে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন মেঘনাদ। অঙ্ক, ইংরাজি, সংস্কৃত ও বাংলা ভাষায় সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে পূর্ববঙ্গের ছাত্রদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করলেন।

আরও পড়ুন- পিথাগোরাস এর জীবনী

১৯০৯ খ্রিঃ ঢাকা কলেজে ভর্তি হলেন এবং ১৯১১ খ্রিঃ আই.এস.সি পরীক্ষায় তৃতীয় স্থান লাভ করলেন।

সেই বছরেই আই.এস.সি পরীক্ষায় প্রথম স্থান পেয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। অবশ্য তখনো পর্যন্ত তাদের মধ্যে চাক্ষুষ পরিচয়ের সুযোগ ঘটেনি, নামেই পরিচিত হয়েছিলেন পরস্পরের কাছে।

মেঘনাদ সত্যেন্দ্রনাথকে সহপাঠী হিসেবে পেয়েছিলেন কলকাতায় ১৯১১ খ্রিঃ প্রেসিডেন্সী কলেজে গণিতে অনার্স নিয়ে ভর্তি হবার পর। সেই সময়ের প্রেসিডেন্সি কলেজ ছিল দেশবরেণ্য শিক্ষক ও ছাত্রদের মিলনে এক মনি-কাঞ্চন ক্ষেত্র বিশেষ।

শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন পার্সিভাল সাহেব, শ্যামদাস মুখোপাধ্যায়, ডি. এন. মল্লিক, জগদীশচন্দ্র বসু, সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র এবং সর্বোপরি প্রফুল্লচন্দ্র রায়।

মেঘনাদ সহপাঠী হিসেবে পেয়েছিলেন, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, সত্যেন্দ্রনাথ বোস, জ্ঞানেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, পুলিনবিহারী সরকার প্রমুখকে। তার এক ক্লাশ ওপরেই ছিলেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ।

প্রেসিডেন্সি কলেজেই মেঘনাদের প্রথম আলাপ হয়েছিল নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে। অবশ্য তখনো তিনি নেতাজি হয়ে ওঠেন নি।

পরবর্তীকালে এদেশে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যাঁরা যুগান্তর ঘটিয়েছিলেন তাঁদের অনেকেই ছিলেন ১৯১৩ খ্রিঃ বি.এস.সি পরীক্ষার্থী। সকলেরই অঙ্কে অনার্স।

ফলাফল প্রকাশিত হলে দেখা গেল প্রথম হয়েছেন সত্যেন্দ্রনাথ বোস, দ্বিতীয় মেঘনাদ সাহা এবং তৃতীয় স্থান অধিকার করেছেন নিখিলরঞ্জন সেন। তিনজনেই মিশ্রগণিত নিয়ে এম এস সিতে ভর্তি হলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। ১৯১৫ খ্রিঃ এম এস.সি পরীক্ষায় সত্যেন্দ্রনাথ-মেঘনাদ দুজনেই হলেন প্রথম।

সত্যেন্দ্রনাথ মিশ্র গণিতে, ফলিত গণিতে মেঘনাদ ৷ স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তাল যুগ সেটা। একদিকে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় উদ্বেল জনচেতনা, অপরদিকে ইংরাজের দমন নিপীড়ন- দেশের পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ। সেই সময় ১৯১৩ খ্রিঃ থেকে ১৯১৫ খ্রিঃ পর্যন্ত প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যয়ন কালে মেঘনাদ অনুশীলন সমিতির কাজকর্মে জড়িয়ে পড়েছিলেন।

তিনি যে মেসে থাকতেন ছাত্রদের মধ্যে সংগঠন গড়বার জন্য সেখানে বাঘা যতীন প্রায়ই আসা যাওয়া করতেন।

অনুশীলন সমিতি ও বাঘা যতীনের সঙ্গে সংস্রব থাকার কারণে মেঘনাদকে সরকারি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হল।

পদার্থ বিজ্ঞানের জগতে সেই সময় নতুন নতুন আবিষ্কার হচ্ছে, বিশ্বময় আলোড়ন তুলছে।

এম এসসি পাশ করার পর আবিষ্কারের উন্মাদনা মেঘনাদ ও সত্যেন্দ্রনাথকেও পেয়ে বসল। মেঘনাদ ঠিক করলেন, তিনি ফলিত গণিত ও পদার্থবিদ্যার গবেষণায় আত্মনিয়োগ করবেন।

যদিও গবেষণার ভবিষ্যৎ তখনো পর্যন্ত ছিল অনিশ্চিত। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর স্তরে তখনো বিজ্ঞান শিক্ষা শুরু হয়নি।

মেঘনাদ সাহা ‘র প্রথম জীবন: Meghnad Saha’s Early Life

প্রয়োজনীয় অর্থ ও সংগঠনের অভাবই ছিল প্রধান অন্তরায়। এই বাধা দূর হয়েছিল আরও দুবছর পরে। স্যার তারকনাথ পালিত ও স্যার রাসবিহারী ঘোষের দানে ১৯১৭ খ্রিঃ থেকে আপার সার্কুলার রোডের নতুন বাড়িতে বিজ্ঞান কলেজের কাজ শুরু হয়েছিল।

বি.এসসি. পরীক্ষায় অসাধারণ মেধার পরিচয় দেওয়ায় স্যার আশুতোষ ১৯১৬ খ্রিঃ মেঘনাদও সত্যেন্দ্রনাথকে ডেকে পাঠিয়ে নবগঠিত বিজ্ঞান কলেজে অধ্যাপনার দায়িত্ব নিতে বললেন।

এই সম্পর্কে সত্যেন্দ্রনাথ লিখেছেন: ( ….. একদিন আমাদের ডেকে পাঠালেন স্যার আশুতোষ। খাড়া সিঁড়ি বেয়ে পাশে লাইব্রেরি ঘরে স্যার আশুতোষের খাস কামরায় হাজির হলাম- আমি মেঘনাদ- শৈলেন।

অবশ্য ভয়ে ভক্তিতে সকলেই বিনীত, নম্র- একেবারে গোবেচারি ভাব। আশুতোষ শুনেছেন নব্যেরা চাচ্ছে নতুন নতুন বিষয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হোক। জিজ্ঞাসা করলেন – তোরা কি পড়াতে পারবি ? ‘ আজ্ঞে, যা বলবেন, তাই যথাসাধ্য চেষ্টা করব। ‘ আশুতোষ হাসলেন- তখন পদার্থ বিজ্ঞানে নানা নতুন আবিষ্কার হয়েছে।

আরও পড়ুন- গ্যালিলিও গ্যালিলি জীবনী

আমরা নামমাত্র শুনেছি। বেশিরভাগ জার্মানিতে, নতুন উন্নতি ও নতুন আবিষ্কার। প্লাঙ্ক, আইনস্টাইন, বোর- তখন শুধু নাম শুনেছে বাঙালি। জানতে গেলে পড়তে হবে জার্মান কেতাব, বা অনুসন্ধান, পত্রিকায় নানা ভাষার।

যুদ্ধের মধ্যে যেসব বেশিরভাগ ভারতে আসে না। মেঘনাদের ওপরে পড়ল কোয়ান্টামবাদ নিয়ে পড়াশুনা- আমাকে পড়তে হবে আইনস্টাইনের রিলেটিভিটি থিওরি। স্বীকার করে এলাম- এক বছরের মধ্যে তৈরি হব। এদিকে বই কোথায় পাওয়া যাবে ? রিলেটিভিটির বিষয়ে ইংরাজিতে বই ছিল, সেগুলি সংগ্রহ হল, তবে বোলজম্যান কার্শ্বেফ-প্লাঙ্কের লেখা কোথায় পাওয়া যাবে? …… মেঘনাদ ও আমি পদার্থবিদ্যা বিভাগ ও ফলিত গণিত– দু’ডিপার্টমেন্টেই লড়াই। …. প্রায় একই সময়ে রামন মনস্থির করে ফেলেন, হিসাব বিভাগের চাকুরিতে ইস্তফা দিয়ে বিজ্ঞান কলেজে আসবেন।

এসেই ডাক পড়লো সহায়কদের। এর আগে আমরাই সব ক্লাসে পড়াই, তিনি চাইলেন অনুসন্ধান কাজ জোরদার হোক। মেঘনাদ বেচারি হাতের কাজে তত পটু নয়- পালিত প্রফেসারের বিরাগ ভাজন হলেন।

অন্য শিক্ষকেরা ঝুঁকলেন রামনের সঙ্গে গবেষণা করে ডক্টর উপাধির চেষ্টায়। … আমি ও মেঘনাদ বস্তুত গণিতের হিসাবই ভাল বুঝি। মিলেমিশে কিছু কাজ করে ছাপিয়েছি।

তবে মেঘনাদের জ্যোতি-বিদ্যায় প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য। নক্ষত্রদের ঔজ্জ্বল্য ও সেই সম্পর্কে তাপের তারতম্য নিয়ে প্রবন্ধগুলি লিখে উচ্চ প্রশংসা পেলেন। ডক্টরেট পেলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।

বিদেশে যাওয়ার জন্য গুরুপ্রসন্ন ঘোষের বৃত্তি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।

মেঘনাদ সাহা ‘র কর্ম জীবন: Meghnad Saha’s Work Life

বিজ্ঞান কলেজে পড়ানো শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও মেঘনাদ সাহা আইস্টাইন ও মিনকোয়াস্কির জার্মান ভাষায় লিখিত আপেক্ষিকতাবাদের ওপরে প্রকাশিত গবেষণাপত্রগুলি ইংরাজি ভাষায় অনুবাদ করে নেন।

এই বইটি পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ। মেঘনাদের ওপর দায়িত্ব ছিল তাপ-বিজ্ঞান এবং তাপগতিবিদ্যা পড়াবার। কোয়ান্টাম তত্ত্ব ও আপেক্ষিক তত্ত্ব তখন সাবেকি পদার্থবিদ্যার প্রচলিত ধারণায়

দ্রুত পরিবর্তন ঘটিয়ে চলেছে। ওদিকে নীলস বোর -এর হাইড্রোজেন বর্ণালী সংক্রান্ত তত্ত্বও প্রকাশিত হয়েছে। এইসব অত্যাধুনিক তত্ত্ব সম্পর্কে তৎকালীন প্রবীণ অধ্যাপকদের অনেকেই কোন ধারণা রাখতেন না। তাদের পড়াশুনা ও চিন্তাভাবনা সনাতন পদার্থবিদ্যার মধ্যেই সীমবদ্ধ ছিল।

কিছুদিনের চেষ্টাতেই তাপ বিকীরণের কোয়ান্টাম তত্ত্ব মেঘনাদ রপ্ত করে ফেললেন। আইনস্টাইনের আপেক্ষিক মতবাদও বাদ রইল না। একই সঙ্গে চলতে লাগল গবেষণার কাজও। গোড়ার দিকে মেঘনাদের গবেষণার বিষয় ছিল বিকিরণ ও চাপ।

আরও পড়ুন- আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় জীবনী

১৯১৮ খ্রিঃ তিনি আলোর চাপ সম্বন্ধে তার ছাত্র সুবোধ চক্রবর্তীর সঙ্গে একটি পরীক্ষামূলক গবেষণা এশিয়াটিক সোসাইটির পত্রিকায় প্রকাশ করেন। পরের বছর, ১৯১৯ খ্রিঃ আমেরিকার অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নালে অন সিলেকটিভ রেডিয়েশন প্রেসার অ্যান্ড ইটস অ্যাপ্লিকেশন ‘ শীর্ষক গবেষণা প্রকাশিত হল। এই বিষয়ে ১৯২১ খ্রিঃ নাগাদ তার তিনটি উল্লেখযোগ্য অবদান

(১) সূর্যের বায়ুমণ্ডলে বিকিরণ ঘটিত সাম্যাবস্থা ও নির্বাচনমূলক চাপ
(২) হাইড্রোজেনের গৌণ বর্ণালী এবং
(৩) সৌর ক্রোমোস্ফিয়ারে আয়নন প্রকাশিত হলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মেঘনাদ বিশ্বজোড়া খ্যাতি লাভ করেন।

সৌর মণ্ডলে এবং নক্ষত্রের আয়ননে তাপমাত্রা ও চাপের প্রভাব বিশ্লেষণই ছিল এইসব গবেষণার মূল প্রতিপাদ্য। এই ভাবেই প্রতিষ্ঠিত হল সাহা আয়নস তত্ত্ব।

সেই সঙ্গে তিনি জ্যোঃতিপদার্থ বিদ্যা, নিউক্লিয় পদার্থবিদ্যা প্রভৃতি ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে ভারতবর্ষে তত্ত্বীয় পদার্থ বিদ্যা গবেষণার পথিকৃৎ হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করলেন।

মেঘনাদ অসাধারণ মেধা ও অধ্যবসায়ের বলে সূর্যের মধ্যে ক্যালসিয়াম, স্ট্রনসিয়াম, বেরিয়াম, হাইড্রোজেন, হিলিয়াম প্রভৃতি মৌলের আয়নমাত্রা অঙ্ক কষে বার করেছেন। পরে ল্যাবরেটরিতে সেগুলো নিজের হাতে মেপে তত্ত্বের সঙ্গে মিলিয়ে হিসেবের অভ্রান্ততা প্রমাণ করেছেন।

১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যেই মেঘনাদ বিশ্বের পদার্থবিদদের সারিতে নিজের স্থান নির্দিষ্ট করে নিতে সক্ষম হলেন। প্রসন্ন ঘোষের বৃত্তি নিয়ে বিদেশে গিয়ে দু বছর ছিলেন। প্রথমে লন্ডনে ইম্পিরিয়াল কলেজে অধ্যাপক আলেকজান্ডার ফাউলার এবং পরে জার্মানিতে অধ্যাপক ওয়াল্টার নার্নস্টের গবেষণাগারে গবেষণা করেন।

১৯২১ খ্রিঃ দেশে ফিরে এসে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার খয়রা অধ্যাপক নিযুক্ত হন।

১৯২৭ খ্রিঃ মেঘনাদ লন্ডনের রয়েল সোসাইটিরি ফেলো নির্বাচিত হন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা বিভাগে একটি উন্নততর গবেষণাগার স্থাপনের চেষ্টা করে মেঘনাদ নানা কারণে ব্যর্থ হয়েছিলেন।

এলাহাবাদ বিশ্ব বিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপকপদে যোগদানের পর ১৯৩২ খ্রিঃ তার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় উত্তরপ্রদেশ অ্যাকাডেমি অব সায়ান্স। ১৯৩৫ খ্রিঃ নাগাদ প্রতিষ্ঠিত হয় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এবং ইন্ডিয়ান সায়েন্স নিউজ অ্যাসোসিয়েশন।

১৯৩৮ খ্রিঃ পর্যন্ত তিনি এলাহাবাদে অধ্যাপনা ও গবেষণার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। ১৯৩৮ খ্রিঃ ফিরে এসে মেঘনাদ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান কলেজে পদার্থবিদ্যা বিভাগের পালিত অধ্যাপক পদে যোগ দেন। এই সময় মেঘনাদ ক্রমশই নিউক্লিয় পদার্থ বিদ্যার প্রতি আকৃষ্ট হন।

১৯৪০ খ্রিঃ তিনি তার দুই ছাত্রের সহযোগিতায় ভারতীয় বিজ্ঞান সংস্থার মুখপত্রে পরমাণু কেন্দ্রের গঠন শীর্ষক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন।

১৯৪৭ খ্রিঃ তাঁরই উদ্যোগে স্থাপিত হল নিউক্লিয় পদার্থবিদ্যার গবেষণাগার ইনসটিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স।

পরবর্তীকালে তারই নামে নামাঙ্কিত হয় এই প্রতিষ্ঠান। তাঁরই চেষ্টায় ভারতবর্ষে প্রথম নিউক্লিয়ার ফিজিক্সকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আগ্রা, এলাহাবাদ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এই বিষয়ে পথপ্রদর্শন করে।

মেঘনাদ সাহা ‘র রাজনৈতিক জীবন: Meghnad Saha’s Political Life

১৯৪১ খ্রিঃ থেকে নিউক্লিয় পদার্থবিদ্যায় সম্পূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৩৪ খ্রিঃ ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতিরূপে সর্বপ্রথম ভারতের সার্বিক উন্নতির প্রয়োজনে বিজ্ঞান প্রয়োগের গুরুত্বের কথা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ব্যক্ত করেন। এই প্রসঙ্গে তিনিই প্রথম নদী উপত্যকা উন্নয়নের কথা বলেন।

সায়ান্স অ্যান্ড কালচার পত্রিকায় দামোদর উপত্যকা সংস্কার, ওড়িশার উন্নয়ন ও ভারতের বিভিন্ন সমস্যার বিষয়ে নিজস্ব মতামত ও প্রস্তাব প্রকাশ করে প্রবন্ধ লেখেন।

তাঁরই লেখা প্রবন্ধে প্রভাবিত হয়ে, ১৯৪৩ খ্রিঃ দামোদরে ভয়াবহ বন্যার পরে, বন্যার কারণ অনুসন্ধানের জন্য কমিশন নিয়োগ করা হয়। তাপীয় আয়নবাদের রচয়িতা মেঘনাদ সাহাই দামোদর নদী পরিকল্পানা রচনা করেছিলেন, সেই ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছে দামোদর ভ্যালী কর্পোরেশন।

আরও পড়ুন- সত্যজিৎ রায় জীবনী

বিজ্ঞানী মেঘনাদকে বিজ্ঞানের প্রয়োজনেই পাঁচের দশকে রাজনীতিতে যোগ দিতে হয়েছিল। ১৯৫১ খ্রিঃ বামপন্থী সমর্থনে নির্দল প্রার্থী হিসেবে তিনি লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।

সেদিন দেশের বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে সমূহ ক্ষতির চিন্তায় শঙ্কিত দেশের বিভিন্ন মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল।

উদ্বিগ্ন দেশবাসীকে আজীবন বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানচর্চার প্রতি বিশ্বস্ত থাকার আশ্বাস জানিয়ে তিনি বলেছিলেন, …. “ বর্তমান সময়ে প্রশাসনের জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, আইন শৃঙ্খলার মতই গুরুত্বপূর্ণ। ধীরে ধীরে আমি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছি। কারণ আমি নিজস্ব পথে দেশের কাজে প্রয়োজনীয় হতে চেয়েছিলাম। ”

সংসদে তিনি শিক্ষা যোজনা, পরমাণু শক্তি, উদ্বাস্তু পূনর্বাসন এবং রাজ্যগুলির পূনণগঠন সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গির কথা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তুলে ধরেছিলেন।

মেঘনাদ সাহা ‘র মৃত্যু: Meghnad Saha’s Death

১৯৫৬ খ্রিঃ ১৬ ফেব্রুয়ারি, দিল্লীতে প্ল্যানিং কমিশনের সভায় যোগদান করতে যাওয়ার সময় এই মহান বিজ্ঞানীর আকস্মিক জীবনপাত হয়।

Leave a Comment