Bhaskar Biography in Bengali – বিজ্ঞানী ভাস্কর এর জীবনী সমগ্র

Bhaskar Biography In Bengali: আজ আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছি মহান ব্যক্তিদের জীবনী সমগ্র। মহান ব্যক্তি আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা। তাঁদের জীবনের ক্ষুদ্রতম অংশগুলি আমাদের জন্য শিক্ষামূলক হতে পারে। বর্তমানে আমরা এই মহান ব্যক্তিদের ভুলতে বসেছি। যাঁরা যুগ যুগ ধরে তাদের কর্ম ও খ্যাতির মধ্য দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন এবং জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প ও সাহিত্যের জগতে এক অনন্য অবদান রেখেছেন এবং তাঁদের শ্রেষ্ঠ গুণাবলী, চরিত্র দ্বারা দেশ ও জাতির গৌরব বৃদ্ধি করেছেন। সেইসব মহান ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম সাহিত্যের অন্যতম বিজ্ঞানী ভাস্কর (Bhaskar) -এর সমগ্র জীবনী সম্পর্কে এখানে জানব।

Bhaskar Biography in Bengali – বিজ্ঞানী ভাস্কর এর জীবনী সমগ্র

নামভাস্কর
জন্ম১১১৪ খ্রিঃ
পিতামহেশ্বর
মাতা
জন্মস্থানমহারাষ্ট্রের বিজ্জদাবির নগর
জাতীয়তাভারতীয়
পেশাগণিতবিদ
মৃত্যু১১৮৫ খ্রিঃ

ভাস্কর কে ছিলেন? Who is Bhaskar?

ভারতে বৈদিক যাগযজ্ঞের সূত্র ধরেই বলতে গেলে বিজ্ঞানের, বিশেষ করে, গণিত, জ্যামিতি ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের সূত্রপাত হয়েছিল। সেযুগে সমাজে যাগযজ্ঞ ও ধর্মীয় নানা ক্রিয়াকান্ডই প্রাধান্য লাভ করেছিল। যজ্ঞের জন্য দরকার হত নানা আকার ও আয়তনের যজ্ঞবেদী। ফলে নানা ধরনের বেদীর ছক কষতে কষতেই জন্মলাভ করল জ্যামিতি।

তেমনি বৈদিক যজ্ঞের সময় ও তিথি নির্ণয় করবার প্রয়োজনে ভারতীয় মনীষীরা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন গ্রহ, সূর্য ও নক্ষত্রের অবস্থান। এভাবেই সূচিত হয়েছিল জ্যোতির্বিজ্ঞানের উন্নতি।

সহজভাবেই অনুমান করা যায় ভারতে গণিতের যাত্রা শুরু হয়েছিল যজ্ঞবেদীর সরল আকার আয়তনের পথেই। কালক্রমে সেই আকার ও আয়তনগুলি জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে। বেদের সূত্রগুলিতেই তৎকালীন সময়ের জ্যামিতির বর্ণনা পাওয়া যায়।

যজুর্বেদে পাওয়া যায় মেধাতিথির দশমিক পদ্ধতিতে সংখ্যা গণনার কথা। ভারতীয় গণিতজ্ঞদের হাতেই উত্তরকালে মেধাতিথির সূত্রানুসন্ধানী স্থান- মূল্য পদ্ধতিতে সংখ্যা লেখার পদ্ধতি প্রচলিত হয়েছে।

আরও পড়ুন- তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় জীবনী

ভারতীয় গণিতে এই স্থান- মূল্য ভিত্তিক (Place values system) সংখ্যা রচনা যুগান্তকারী বিপ্লবের সূচনা করেছিল। আবির্ভাব সম্ভব করে তুলেছিল আর্যভট্ট, বরাহমিহির এবং ব্রহ্মগুপ্তের মত গণিতবিজ্ঞানীদের। তাঁদের অবদানে ভারতীয় বিজ্ঞানের গণিত শাখার ইতিহাসে অনিবার্যভাবে নানা পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল।

কালক্রমে জ্যামিতি থেকেই গণিতের ধারা বিবর্তিত হয়েছিল পাটিগণিতের দিকে। কালক্রমে ভারতীয় গণিতের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল আরও একটি ধারা তা হল বীজগণিত।

আর্যভট্ট, বরাহমিহির এবং ব্রহ্মগুপ্তের হাতেই রোপিত হয়েছিল বীজগণিতের বীজ। বীজগণিতের স্পষ্ট রূপদান যিনি করেছিলেন তিনি হলেন ভাস্কর। ভারতীয় গণিতের অঙ্কুরোদগম ঘটিয়েছিল ভাস্করের (Bhaskar) গণিত গবেষণা।

উল্লেখযোগ্য যে ভারতবর্ষে ভাস্করের (Bhaskar) কাল দ্বাদশ শতকের সময়সীমার মধ্যেই বীজগণিতের যে অগ্রগতি ঘটেছিল, সমসাময়িক পৃথিবীর কোন প্রান্তেই অনুরূপ কোন বিস্ফোরণ ঘটেছে এমন যুগান্তকারী ঘটনার সন্ধান বিশ্ববিজ্ঞানের ইতিহাসে অনুপস্থিত।

ভাস্করের অনুরূপ চিন্তাভাবনার পরিমন্ডলে পৌছতে ইউরোপীয় গণিত বিজ্ঞানকে ১৭ থেকে ১৮ শতক পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল।

স্বভাবতঃই বিজ্ঞানী ভাস্করের (Bhaskar) জীবন ও সাধনার কথা জানবার জন্য আমাদের আগ্রহ সৃষ্টি হয়।

আরও পড়ুন- ভীমরাও রামজী আম্বেদকর জীবনী

কিন্তু ভারত এমনি এক আত্মপ্রচারবিমুখ ও নিস্পৃহ আদর্শ কর্মজীবনে অনুসরণ করে যে প্রাচীন বিজ্ঞানীদের কর্মের আশীর্বাদই কেবল দেশবাসী গ্রহণ করেছে, তাদের ব্যক্তিজীবনের খুঁটিনাটিসুদ্ধ সকল জ্ঞাতব্য মহাকাল সকৌতুকে অপহরণ করেছে।

উত্তরকালে বিজ্ঞানীদের জন্ম ও জীবনের পরিবর্তে তাদের কর্মজীবনের কীর্তির মধ্যেই আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে।

সাহিত্য সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই এই ধারা শতাব্দীর পর শতাব্দী অব্যাহত ছিল। তার মধ্যে দু-একটি ব্যতিক্রমের সন্ধান পাওয়া যায়, যেমন বৌদ্ধ চিকিৎসাশাস্ত্র ও রসায়ন শাস্ত্রের অবিনশ্বর প্রতিভা জীবক।

সমকালের বৌদ্ধ শাস্ত্রকারগণের কল্যাণেই তাঁর সম্পর্কে জানা সম্ভব হয়েছে। ভাস্করের আবির্ভাব ঘটেছিল দ্বাদশ শতকে। সেই সময়ে অবস্থার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে।

ভাস্কর এর জন্ম: Bhaskar’s Birthday

ভাস্কর-পরবর্তী শাস্ত্রগুলোতে তার কর্ম-সাধনা ও জীবনের অনেক তথ্যই লিপিবদ্ধ হয়েছে। আমরা জানতে পেরেছি, মহারাষ্ট্রের বিজ্জদাবির নগরে ১১১৪ খ্রিঃ এক ব্রাহ্মণ পরিবারে ভাস্করের জন্ম।

তাঁর পিতা মহেশ্বর ছিলেন গণিত অনুরাগী মানুষ। তিনি বাল্যবয়স থেকেই পুত্রকে গণিতের শিক্ষা দেন।

সেই শিক্ষাই ভাস্করের প্রতিভাগুণে উত্তরকালে বিকশিত হয়ে ভারতের গণিত চর্চার ইতিহাসকে আলোকিত করেছিল।

ভাস্করের প্রতিভা তাঁর পুত্র লক্ষ্মীদার এবং পৌত্র গঙ্গাদেবও উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছিলেন। তারা দুজনেই গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানীরূপে খ্যাতিলাভ করেছিলেন।

ভাস্কর এর রচনা: Written by Bhaskar

কৈশোরেই গণিতের অসামান্য প্রতিভার জন্য ভাস্কর সুখ্যাতি লাভ করেছিলেন। তার গণিত বিজ্ঞানের বই সিদ্ধান্ত শিরোমণি লেখার পর সমগ্র ভারতে তার নাম ছড়িয়ে পড়েছিল। ভাস্করের বয়স যখন ৩৬ বছর, ১১৫০ খ্রিঃ সিদ্ধান্ত শিরোমণি লিখিত হয়। পরবর্তীকালে ১১৮৩ থেকে ১১৮৪ সালের মধ্যে তিনি রচনা করেছিলেন কারণ কৌতূহল। এই বই রচনার সময় ভাস্করের বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর।

দ্বাদশ শতকে ভারতের মাটিতে মুসলমান সভ্যতা ও সংস্কৃতির সম্প্রসারণ ঘটেছে। সেই সময় প্রাচীন বিজ্ঞানীদের মূল পান্ডুলিপিগুলি অধিকাংশই বিনষ্ট হয়েছে, কিছু পাচার হয়েছে বিদেশে।

ইতিহাসের এই সঙ্কটকালেই ভাস্কর তাঁর গবেষণার আলোতে ভারতীয় গণিত চর্চার ইতিহাসকে আলোকিত করেছিলেন। ভাস্করের অতুলনীয় প্রতিভার স্বাক্ষর রয়েছে তার সিদ্ধান্ত শিরোমণি গ্রন্থে। বইটি চারভাগে বিভক্ত।

প্রথমেই রয়েছে সংখ্যা নিয়ে সরল ও জটিল গবেষণা। এই ভাগের নাম পাটীগণিত। পরবর্তী ভাগের নাম বীজগণিত। তৃতীয় ও চতুর্থ ভাগের নাম যথাক্রমে গ্রহগণিত-অধ্যায় ও গোলাধ্যায়।

আরও পড়ুন- রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় জীবনী

এই দুই ভাগে গ্রহ এবং গোলকের গাণিতিক আলোচনা করা হয়েছে। ভাস্করের গ্রন্থে গণিত অধ্যায়ে আর্যভট্ট এবং ব্রহ্মগুপ্তের সঙ্গে দুই প্রাচীন গণিত গবেষক লাল্লা ও শ্রীধরের তত্ত্বগুলোর স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

পাটীগণিত অধ্যায়ে বীজগণিতের কোন উল্লেখ ছিল না। তবে শেষ দিকে কিছু জ্যামিতি রয়েছে।

ওজন ও পরিমাপের একক দিয়ে শুরু হয়ে প্রায় কুড়ি ধরনের গাণিতিক প্রয়োগ দেখানো হয়েছে- যেমন যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ, বর্গ, বর্গমূল, ঘনক, ঘনমূল, ভগ্নাংশ হ্রাসের পঞ্চপ্রকরণ, প্রত্যক্ষ ও বিপরীত তিন নিয়ম, পাঁচ, সাত, নয় এবং ১১ সংখ্যাসীমা এবং বিনিময় ইত্যাদি।

মিশ্রণ, প্রগতি, সমতল, ঘনক, পালুই, করাত, শস্যটিবি, ছায়াঘড়ির ছায়া, অনির্ণেয় দ্বিপদী সমীকরণ, ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, বৃত্তের ক্ষেত্রফল, গোলকের আয়তন, শঙ্কু, পিরামিড বা সূচী-ঘনক্ষেত্র প্রভৃতি নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন ভাস্কর।

ভাবতে আশ্চর্য লাগে, মধ্যযুগের সেই অস্থির সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্যে থেকেও কী নিবিড় নিষ্ঠা ও অধ্যবসায় বলে ভাস্কর ভারতীয় বিজ্ঞানের ধারাটিকে অব্যাহত রেখেছিলেন।

আরও পড়ুন- উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী জীবনী

সিদ্ধান্ত শিরোমণির দ্বিতীয় ভাগ হল বীজগণিত। আক্ষরিক অর্থেই এখানে স্থান পেয়েছে বিশ্লেষণী গণনা।

ভাস্করের বীজগণিতের ২১৩ টি পংক্তি ভারতীয় গণিত আজও সগৌরবে বহন করে চলেছে।

আধুনিক বীজগণিতের প্রসার সত্ত্বেও ভাস্করের বীজগণিতের আবেদন এতটুকু ক্ষুণ্ণ হয়নি।

শূন্য সংক্রান্ত নানা গণনা এবং ধনাত্মক ও ঋণাত্মক নানা সংখ্যা ও পরিমাণের তত্ত্ব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে বীজগণিত অংশে।

ভাস্কর তার বীজগণিত অংশে সবচেয়ে বেশি কৃতিত্বের পরিচয় রেখেছেন অনির্ণেয় সমীকরণ ঘটিত বিশ্লেষণী গণনায়। এই ক্ষেত্রে অবশ্য তিনি পূর্ববর্তী ভারতীয় গণিত বিজ্ঞানীদের অবদানকেও সার্থকভাবে প্রয়োগ করেছেন।

দ্বিপদী সমীকরণের অনির্ণেয় ভাবের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভাস্কর বীজগণিতের সঙ্গে জ্যামিতিরও সাহায্য নিয়েছেন।

গণিতের পাশাপাশি জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণাতেও আত্মনিয়োগ করেছিলেন ভাস্কর। তাঁর গ্রহগণিত অধ্যায়ে তিনি গ্রহতারার অবস্থানের গণনা লিপিবদ্ধ করেছেন।

আরও পড়ুন- অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনী

তার এই গবেষণার ভিত্তি ছিল সূর্য সিদ্ধান্ত। তার অনুসরণে তিনি গ্রহদের গতিকে বায়ুর গতির সঙ্গে যুক্ত করেছেন।

আপাতদৃষ্টিতে তার এই কাজকে অবৈজ্ঞানিক সুলভ মনে হলেও, তিনি আশ্চর্য এক তত্ত্ব তৈরি করতে পেরেছিলেন। অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র এক বৃত্ত অপেক্ষাকৃত বড় একটি বৃত্তের পরিধির ওপর তার কেন্দ্র অবস্থিত এবং ওই কেন্দ্রকে আশ্রয় করে ক্ষুদ্র বৃত্তটি আবর্তিত হচ্ছে- ভাস্করের এই তত্ত্বকেই জ্যোতির্বিজ্ঞানের আধুনিক ভাষায় নাম দেওয়া হয়েছে EP- CYCLE।

এই তত্ত্বের সাহায্যেই তিনি নানা গ্রহের ঘুর্ণনের ব্যাখ্যা করেছেন। নানা গোলকের আকার ও আয়তন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে সিদ্ধান্ত শিরোমণির শেষ ভাগ গোলাধ্যায় অংশে।

ভারতীয় গণিত বিজ্ঞানের ইতিহাসে প্রাচীন ও মধ্যযুগের পরিধিতে ভাস্করই ছিলেন শ্রেষ্ঠ গণিত বিজ্ঞানী।

তার গবেষণা অনুসরণ করে পরবর্তীকালে বহু ভাষ্য রচিত হয়েছে। দেশে দেশে ভাস্করের অনুবাদ প্রকাশিত হয়। এইভাবেই স্বমহিমায় ভাস্কর বিশ্ববিজ্ঞানের ইতিহাসে নিজের স্থান করে নিয়েছেন।

ভাস্কর এর মৃত্যু: Bhaskar’s Death

৭১ বছর বয়সে ১১৮৫ খ্রিঃ ভাস্করের মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর ৪০০ বছর পরে ভারতসম্রাট আকবর সিদ্ধান্ত শিরোমণির পাটীগণিত অধ্যায় অনুবাদ করিয়েছিলেন বিশিষ্ট পন্ডিত আবুলফজলকে দিয়ে।

আরও পরে ১৬৩৪ খ্রিঃ প্রাচ্যবিষয়ক পন্ডিত আতাউল্লা রুশটি বীজগণিত অংশের অনুবাদ করেছিলেন।

Leave a Comment