সালিম আলি জীবনী – Salim Ali Biography in Bengali

সালিম আলি জীবনী (Salim Ali Biography): আজ আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছি মহান ব্যক্তিদের জীবনী সমগ্র। মহান ব্যক্তি আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা। তাঁদের জীবনের ক্ষুদ্রতম অংশগুলি আমাদের জন্য শিক্ষামূলক হতে পারে। বর্তমানে আমরা এই মহান ব্যক্তিদের ভুলতে বসেছি। যাঁরা যুগ যুগ ধরে তাদের কর্ম ও খ্যাতির মধ্য দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন এবং জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প ও সাহিত্যের জগতে এক অনন্য অবদান রেখেছেন এবং তাঁদের শ্রেষ্ঠ গুণাবলী, চরিত্র দ্বারা দেশ ও জাতির গৌরব বৃদ্ধি করেছেন। সেইসব মহান ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম সালিম আলি (Salim Ali) -এর সমগ্র জীবনী সম্পর্কে এখানে জানব।

সালিম আলি জীবনী – Salim Ali Biography in Bengali

নামসালিম আলী (সালিম মঈজুদ্দীন আব্দুল আলি)
জন্ম12 নভেম্বর 1896
পিতামইজুদ্দীন
মাতাজিনাত-উন-নিসা
জন্মস্থানবোম্বে, বোম্বে প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত
জাতীয়তাভারতীয়
পেশাপক্ষীবিদ এবং প্রকৃতিপ্রেমী
মৃত্যু20 জুন 1987 (90 বছর বয়স)

সালিম আলী কে ছিলেন? Who is Salim Ali?

খাঁচার পাখি আর বনের পাখির সুখ দুঃখ নিয়ে মানুষের ভাবনার বিলাসিতার অন্ত নেই। কবিরা তো ঝাকে ঝাকে কাব্য কবিতা রচনা কিছু কম করেননি।

কিন্তু তাই বলে পাখির মাংসে তাদের রুচি কখনো কমে যেতে দেখা যায় নি। এখন তো সখের দরদীরা হাটে মাঠে মেলায় খাঁচাবন্দি পাখি বিক্রী হতে দেখে তাদের নির্যাতন মুক্তির বিলাসী-অভিযান দেখিয়ে মহাকর্তব্য সাধনের তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন- চোখের সামনেই এসব কান্ড দেখা যায়।

আসলে, পাখি পোষা, পাখিকে খাঁচা থেকে মুক্ত করে দেওয়া, পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে-প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কাজেই পাখি বাঁচাও অভিযান হাঁকাও- এসব কিছুর সঙ্গে পাখিকে ভালবেসে, তাদের জীবনযাত্রা, জন্মান, বেঁচে থাকা হাল চাল এসবের খবর রাখা ব্যাপারগুলোর পার্থক্য আকাশ-পাতাল! একটা পাখির ধরন-ধারণ লক্ষ্য করা যদিও বা সম্ভব বলে ভাবা যেতে পারে, একটা গোটা দেশের অসংখ্য বিচিত্র পাখির ঠিকুজিকুষ্টির খবর রাখার কথা চিন্তাও করা যায় না। অথচ আমাদের দেশের একটি মানুষ এমন অসম্ভব দুঃসাধ্য কাজ করেই ক্ষান্ত হননি, গোটা দেশের সমস্ত পাখির জীবনযাত্রার বিবরণ নিয়ে মহাভারত প্রমাণ বই লিখে পৃথিবীর মানুষের বিস্ময় উৎপাদন করেছিলেন।

কেবল তাই নয়, তাঁর সংগৃহীত তথ্য জীববিজ্ঞানের উন্নতির ক্ষেত্রে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেছে। সালিম আলি মনেপ্রাণে ভালবেসেছিলেন পাখিদের। কেবলমাত্র পাখির জীবন পর্যবেক্ষণ করেই যে একানব্বই বছরের গোটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায় তার জাজ্জ্বল্যমান প্রমাণ তিনি নিজেই।

মৃত্যুর আগে অবধি পাখিদের জীবনরহস্য অবাক বিস্ময়ে পর্যবেক্ষণ করে গেছেন সালিম আলি।

সালিম আলী ‘র জন্ম: Salim Ali’s Birthday

সালিম আলী ১৮৯৬ সালের ১২ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন।

এই দেখা শুরু হয়েছিল ছেলেবেলা থেকে। তখনকার দেখার মধ্যে অবশ্য একটু বিশেষত্ব ছিল। তা হল, ভালবাসা ছিল না- যা পরে তার দেখাকে মহিমান্বিত করেছিল।

আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগে, সালিম আলির ছেলেবেলায়, একটা এয়ার গানের মালিক হয়েছিলেন তিনি। অভিভাবকদের কারোর কাছ থেকে উপহার পাওয়ার সুবাদে এই মালিকানার স্বত্ব ৷ তার ফলে অন্য দশটা বাচ্চা যা করে, তিনিও স্বাভাবিকভাবেই তাই করতেন।

টিপ পরীক্ষা করতে করতেই, সে কাজটা প্রধানতঃ হত বাড়ির আশপাশে হাতের কাছে যেসব পাখি, প্রজাপতি ইত্যাদি পাওয়া যেত তাদেরই ওপর, পাওয়া গেল একদিন অন্য স্বাদ। মুম্বাইতে যেখানে তাঁদের বাড়ি ছিল, তার আশপাশে নানা ধরনের পাখিই পাওয়া যেত।

কিছুদিন যেতে না যেতেই দেখা গেল, সব টিপই ফস্কাচ্ছে না। দু-একটা পাখি ঘায়েলও হচ্ছে।

একদিন একটা চড়াই হাতে ঝুলিয়ে বাড়ি ফিরলেন আলি। কেউ দেখতে না পার সেভাবে এনে সদ্য মরা পাখিটা বাড়ির রাঁধুনির হাতে তুলে দিলেন। বুদ্ধিটা বাতলে দিয়েছিল অবশ্য সেই। সে চড়াইপাখির পালক ছাড়িয়ে গায়ে যৎসামান্য মশলা মাখিয়ে আস্ত ভেজে দিল। প্রথম দিন থেকেই এই সুস্বাদু খাবারের স্বাদ পেয়ে মৌতাত ধরে গেল।

এরপর থেকে মাঝে মধ্যেই চলল আলির চড়াই ভাজা খাওয়ার পর্ব। জানতে পেত না কেউ। কেন না কাজটা করা হত অত্যন্ত গোপনে। একদিন আচমকা বাধা পড়ল। সেদিন একটা চড়াই মেরেছে আলি। সরাসরি চলে এল রঁসুই ঘরে।

আরও পড়ুন: জগদীশচন্দ্র বসু জীবনী

কিন্তু রাঁধুনির হাতে দিতে গিয়েই হঠাৎ নজরে পড়ল পাখিটার গলার নিচের দিকের পালকে কেমন হলদে ছোপ। মনে হচ্ছে যেন হঠাৎ ঝোল চলকে পড়েছে। আলি এবারে ভাল করে পরীক্ষা করে বুঝতে পারলেন, পাখিটা চড়াইর মত দেখতে হলেও ঠিক সাধারণ চড়াই নয়৷

রাঁধুনিও বলতে পারল না কিছু। আলির ধন্ধ লাগল। এ পাখি আগে কখনো দেখেনি, এসব খাওয়ার চল আছে কিনা কে জানে। না জেনে খাওয়া ঠিক হবে না। পাখিটা নিয়ে তিনি ছুটলেন মামার কাছে। আলিরা ভাইবোনে মিলে ছিলেন আটজন। আলির যখন তিন বছর বয়স, তার মধ্যেই বাবা-মা দুঞ্জনকেই হারিয়েছেন।

তারপর থেকেই দাদা-দিদিদের সঙ্গে মানুষ হচ্ছিলেন মামা আমিরুদ্দিন তায়েবজির কাছে। মামা খুবই বিদ্বান মানুষ।

তার কাছেই আলির যাবতীয় শিক্ষাদীক্ষা। মামা আর এই পরিবারের অনেকেরই ছিল শিকারে নেশা। তাঁদের কেউ যখন শিকারে বেরুতেন, মাঝে মাঝেই সঙ্গ নিতেন আলি।

একবার এমনি শিকারে বেরিয়ে চোখে পড়েছিল পুবের আকাশে ধাবমান উজ্জ্বল আলোর একটা রেখা। পরে জেনেছিলেন সেটা হ্যালির ধূমকেতু।

ওই বিখ্যাত ধূমকেতুটা জীবনে দুবার দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন আলি। খুব কম মানুষের জীবনেই হ্যালির ধূমকেতু দুবার দেখার সুযোগ ঘটেছে। চড়াই পাখিটা আমিরুদ্দিন হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলেন। কিন্তু আসলে ওটা কি পাখি চিনতে পারলেন না। আলির তখন কেমন রোখ চেপে গেছে। পাখিটার সঠিক পরিচয় জানতে হবে।

গলায় অমন হালকা হলুদ ছোপওয়ালা পাখি আগে কখনো চোখে পড়েনি তার। আমিরুদ্দিন ভাগ্নের আগ্রহ লক্ষ্য করে তাকে পাঠিয়ে দিলেন মুম্বাই ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটিতে। পশুপাখি উদ্ভিদের আকৃতি-প্রকৃতি পরিচয় জানায় আগ্রহী কিছু মানুষ মিলে গড়ে তুলেছিলেন এই সংস্থা। আলির মামাও ছিলেন সদস্যদের একজন৷

বাকি প্রায় সকলেই লালমুখো সাহেব। এদেশে তখন সাহেবদের রাজত্ব। স্বভাবতই এদেশি মানুষদের মনে তাদের সম্পর্কে একটা ভর ও সম্ভ্রমের ভাব। কিশোর আলি কিন্তু এতটুকু ইতস্ততঃ করলেন না। একটা কাগজের ঠোঙার মধ্যে মরা পাখিটা ভরে নিয়ে চলে এলেন সোসাইটির অফিসে।

মিলার্ড নামে এক সাহেবের সঙ্গে দেখা করে পাখিটা দেখালেন। মিলার্ড ছোট্ট আলির সব কথা মন দিয়ে শুনলেন।

আলির আগ্রহ দেখে খুবই খুশি হলেন তিনি। হাসিমুখে পাখিটার পরিচয় জানিয়ে বললেন, ওটা সাধারণ ঘরোয়া চড়াই নয় ৷

ওটার ইংরাজি নাম ইয়েলোথ্রোটেড স্প্যারো। গলার হলদে দাগটাই এই চড়াইয়ের বিশেষত্ব ৷ নানা ধরনের পাখি সংরক্ষণের জন্য একটি নির্দিষ্ট ঘর ছিল।

পাখিদের গা থেকে পালকসহ ছালটা ছাড়িয়ে নিয়ে তার ভেতরে তুলো গুঁজে আসল পাখিটার আদল ফিরিয়ে আনা হত। এই ধরনেব অসংখ্য নমুনা সেই ঘরে রাখা ছিল। আলির জানার আগ্রহ সাহেবকে এতই মুগ্ধ করেছিল যে, তিনি সমিতির দুজন সদস্যের সঙ্গে আলিকে পাখির যাদুঘরে পাঠিয়ে দিলেন।

মস্ত ঘরের দেয়াল জুড়ে সারিসারি কাঠের খোপে সাজানো অসংখ্য রং-বেরঙের বিচিত্র সব পাখি ৷ দেখে জীবন্ত বলে ভ্রম হয়। রঙের এমন আশ্চর্য শোভন ব্যবহার যে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া যায় না, স্তব্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতে হয়। যদিও মারা যাবার পর রঙের আসল জেল্লা কিছুটা কমে গেছে।

পাখিদের চেহারার মধ্যেও কত বৈচিত্র্য। এক এক রকম পাখির ঠোটের গড়নও এক এক রকম। কারও মাথায় ঝুঁটি, ঝুঁটির বাহারও কতরকম। কারও গলা ঘিরে রিঙ-এর মত রঙের দাগ। কারও আঙুলে বড় বড় নখ, কারও চোেখ কাজলটানা। কারো কারো লেজ তাদের শরীরের তিন চারগুণ লম্বা। এইসব দেখতে দেখতে একেবারে নতুন এক জগতে পৌঁছে যান আলি।

ঘোর লেগে যায় চোখে ও মনে। আকুল আগ্রহে মন ছটফট করে ওঠে, বাহারি রঙ আর রুপের আর বিচিত্র আকার আকৃতির পাখিদের জীবনের চলাফেরা কলকাকলি দেখবার জন্য।

এরপর থেকে এয়ার গানের বদলে হাতে উঠল বাইনোকুলার। আর পাখি হত্যা নয়- এবারে শুধু দেখা- চোখ ভরে দেখা আর মন ভরে উপভোগ করা। এযে কী আনন্দ আর তৃপ্তি। পাখি দেখার প্রথম পর্ব শুরু হয়েছিল বর্মার জঙ্গলে। তখন আঠারো-উনিশ বছরের কিশোর। পড়াশোনা তখনো অসম্পূর্ণ।

কিন্তু সংসারের প্রয়োজন বড় বালাই। এক দাদার কাঠ আর খনিজের ব্যবসায় যোগ দেবার জন্য ছুটতে হয়েছিল বর্মায় ৷ জঙ্গলে কাঠ কাটার তদারকি করতে হত।

সেই কাজ করতে করতেই পাখির স্বর্গে পৌঁছে গিয়েছিলেন আলি। রঙ আর রূপের চাইতে পাখিদের আচার-আচারণের প্রকৃতিই যেন বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠল তাঁর কাছে। শুরু হয়েছিল বার্মার জঙ্গল থেকে। তারপর পাখিদের টানে গোটা ভারতবর্ষ চষে বেড়িয়েছেন তিনি।

পুবে বার্মা থেকে পশ্চিমে আফগানিস্তান, উত্তরে তিব্বতের মালভূমি কৈলাস মানসসরোবর থেকে দক্ষিণে শ্রীলঙ্কা কোথায় না গেছেন তিনি।

কেবল পাখিদের জীবন দেখবার জন্য–কেমন তাদের চলাফেরা, ডেরা বাঁধা, কেমন ওদের জীবন চলন -এসব দেখার টানে পাহাড় জঙ্গল, দুর্গম দুস্তর পথ, বাঘ-হাতি, সাপখোপ কোন কিছুর তোয়াক্কা করেননি তিনি। জলে কাদায় কাটাতে হয়েছে দিনের পর দিন।

এই সময় ডাকাতের হাতেও পড়তে হয়েছে তাঁকে, জীবনও বিপন্ন হয়েছে বহুবার। কোনও বিশেষ পাখির হদিস করবার জন্য খাড়া পাহাড়ে চড়তে হয়েছে কোথাও জীবন হাতে করে। একবার লিপুলেখ গিরিপথে পাখির দিকে নজর রেখে পেছনে হটছেন।

হঠাৎ গড়িয়ে পড়া পাথরের শব্দে পেছন ফিরে দেখেন সর্বনাশ, একেবারে খাদের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছেন। আর একটু হলেই অতল খাদে পড়ে প্রাণ হারাতে হত। একেবারে শেষ মুহূর্তে দৈবক্রমে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছিলেন সেদিন।

জলকাদায় জিপের চাকা অচল হয়ে কতবার যে বিব্রত হয়েছেন তার হিসেব কে করবে।

তবু ছুটেছেন, পাখি দেখার আকর্ষণে। আলির কাছে এই আকর্ষণ এমনই অমোঘ ছিল যে, যখন জীবন নব্বই-এর কোঠায় পৌঁছেছে সেই সময়েও এক দুর্লভ পাখি–বহুদিন খুঁজেও যার হদিস করতে পারেননি, তার খোঁজে কুমায়ুন হিমালয়ের জঙ্গলে অভিযানে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। আজও পর্যন্ত সেই পাখির সন্ধান পাওয়া যায়নি- সেই দুর্লভ পাখিটি হল মাউন্টেন কোয়েল।

ভারত স্বাধীন হবার আগে এদেশে বহু ছোট ছোট রাজ্য ছিল। সাহেবরা সেসব রাজ্যে পাখির সন্ধানে যেতেন ৷

কিন্তু তারা কেবল পাখির প্রকারভেদ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতেন ৷ পাখিদের জীবন, চালচলন, ধরনধারণ নিয়ে তারা বড় একটা মাথা ঘামাতেন না।

আলি সে কাজটা করতেন সুচারু ভাবে। রাজাদের অনুমতি নিয়ে দিনের পর দিন পাহাড়ে জঙ্গলে, নদীর চরে, তাঁবু খাটিয়ে বাস করেছেন। পাখিদের স্বভাব লক্ষ্য করবার জন্য মাইলের পর মাইল পাড়ি দিতে হয়েছে স্রেফ পায়ে হেঁটে।

কখনো ঘেরাটোপ আড়ালে বসে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অবিচল ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করতে হয়েছে। প্রতিমুহূর্তে সতর্ক থাকতে হয়েছে, কোন ভাবে না তার অস্তিত্ব পাখিদের নজরে পড়ে যায়। পর্যবেক্ষণের জন্য কখনো কখনো পাখি ধরতেও হয়েছে জাল পেতে।

বাধ্য হয়ে গুলি করে নামাতেও হয়েছে কতবার। সালিম আলির পাখি দেখার কাজ সাধারণ মানুষের চোখে অদ্ভুত ঠেকলেও যারা সমঝদার তাদের সহযোগিতা পেতে কখনো অসুবিধা হয়নি তার।

একবার, তখন তিনি তাবু ফেলেছেন কোচিনের জঙ্গলে। জঙ্গল ফুঁড়ে যেতে যেতে এক ট্রেনের ড্রাইভার তাকে একটা মরা বাজ উপহার দিয়ে গিয়েছিল।

ট্রেনের খোলা ওয়াগনে মজুদ মুরগির ওপর ছোঁ মারতে গিয়ে পাখিটা মারা পড়েছিল। একটা জ্বলন্ত চ্যালাকাঠ ছুঁড়ে মেরেছিলেন পাখিটাকে সেই ড্রাইভার ভদ্রলোক।

আলি পরে পরীক্ষা করে খুশি হয়েছিলেন, দুর্লভ এক প্রজাতির বাজ হাতে পেয়েছিলেন নিতান্ত আকস্মিকভাবে ট্রেনের ড্রাইভার ভদ্রলোকের সৌজন্যে। এদেশে সাহেবরা পাখিদের ওপর যে কাজ করেছেন, তা ছিল এক ধরনের।

তাঁরা খুঁজতেন পাখিদের মাপজোখ, শরীরের রঙবেরঙের খুঁটিনাটি হিসাব, ডিমের মাপ আর গড়ন। এসবের বাইরে বড় একটা তারা মাথা ঘামাতেন না। সুযোগ মত নমুনা হিসেবে পাখির চামড়াটা সংরক্ষণ করতেন।

আলির হাতেই শুরু হয়েছিল পাখিদের আচার-আচরণ, স্বভাবচরিত্র, জীবনযাত্রা নিয়ে খুঁটিনাটি অনুসন্ধানের কাজ। মরা পাখির চামড়া সংগ্রহ করার তুলনায় জীবন্ত, পাখিদের স্বাভাবিক জীবনে অভ্যস্থ চালচলন লক্ষ্য করাতেই বেশি উৎসাহ ছিল আলির। যৌবনে বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটিতে কিছুদিন দর্শকদের কাছে পাখি আর প্রকৃতি বোঝাবার কাজ করতে হয়েছিল আলিকে।

আরও পড়ুন: গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য জীবনী

তারপর পক্ষিবিজ্ঞানের উচ্চতর শিক্ষা লাভের জন্য জার্মানি গিয়েছিলেন ১৯২৯ খ্রিঃ। একবছর পরেই দেশে ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু পুরনো চাকরিতে ততদিনে নতুন লোক নিয়োগ হয়ে গিয়েছিল। ফলে স্ত্রীকে নিয়ে আলিকে মুম্বাই শহর থেকে দুরে কিহিম অঞ্চলে কম খরচের ডেরায় চলে যেতে হয়েছিল।

এখানে এসে পাখির জগতের এক নতুন দিকের আবিষ্কার করতে পারলেন। বাবুই পাখিদের বাসা বানাবার অদ্ভুত রীতি-প্রকৃতির বিষয় আগে কোন পক্ষি বিজ্ঞানীর নজরে আসেনি। এবিষয়ে প্রথম তথ্য সংগ্রহ করেন আলি।

মাটি থেকে দশ-বারো ফুট উঁচু একটি মাচার ওপরে ঘেরাটোপের মধ্যে দিনের পর দিন বসে থেকে আলি লক্ষ্য করতেন বাবুই পাখিদের।

তিনি লক্ষ্য করলেন, পুরুষপাখিরা অর্ধেক বাসা বানিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। একসময় একঝাক মেয়ে বাবুই এসে অর্ধসমাপ্ত বাসাগুলো ঘুরে ঘুরে নিজেদের পছন্দমত বাসা বেছে নেয়।

মেয়ে বাবুইদের যে যে বাসা পছন্দ হয় পুরুষ পাখিরা সেগুলোর কাজ শেষ করে আবার নতুন বাসা বানাবার কাজে হাত দেয়।

নতুন বাসায় অন্য আরো মেয়ে বাবুইকে ডেকে আনার উদ্দেশ্যেই তাদের এই পরিশ্রম করতে হয়।

কোনও কারণে প্রথম বাসাটা যদি কারও পছন্দ না হয় তাহলে গোটা কাজটাই বাতিল হয়ে যায়। খাটাখাটুনি বিফলে যায়। নতুন করে আবার বাসা বানাবার কাজে লাগতে হয়।

কাছে দূরে ঘুরে ঘুরে যেসব অদ্ভূত আশ্চর্য অভিজ্ঞতা লাভ হত, সব নিয়ম করে টুকে রাখতেন আলি একটা খাতায়। সেই সব তথ্য সাজিয়ে প্রাসঙ্গিক ছবি আর নানান পাখির বিবরণ নিয়ে একের পর এক বই লিখেছেন। তার ভারত ও পাকিস্তানের পাখিদের হ্যান্ড বুক দশ খন্ডে সম্পূর্ণ।

উপমহাদেশের বিচিত্র পাখিদের নিয়ে এমন বিস্তৃত ও ব্যাপক গবেষণা আলির আগে আর কোন পক্ষিগবেষকের পক্ষে করা সম্ভব হয়নি। আলির বিখ্যাত বই বুক অব ইন্ডিয়ান বার্ডস প্রকাশিত হয় ১৯৪১ খ্রিঃ।

বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে এই বইটি। জেলবন্দি অবস্থায় এই বই পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন জহরলালও। একই সময়ে ভারতের অন্য জেলে বন্দিনী কন্যা ইন্দিরাকেও জহরলাল বইটি উপহার পাঠিয়েছিলেন।

পৃথিবীতে আমাদের পরিবেশ বাসযোগ্য রাখার জন্য যে পাখিদেরও অবদান রয়েছে তা তার বিভিন্ন বইতে বারবার উল্লেখ করেছেন আলি। লুপ্তপ্রায় পাখিদের সংরক্ষণের ব্যাপারেও তিনি ব্যবস্থা নেবার কথা বলেছেন। প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য সব রকম পাখির ভূমিকাই প্রকৃতি নির্দিষ্ট করে দিয়েছে।

এ ব্যাপারে প্রতিটি মানুষেরই যে সচেতন থাকার প্রয়োজন আছে পক্ষিবিজ্ঞানী সেলিম আলি তাঁর সুদীর্ঘ গবেষণার প্রতিস্তরেই গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন, লেখায় প্রকাশ করেছেন।

সালিম আলী ‘র পুরস্কার ও সম্মান: Salim Ali’s Awards And Honors

নিজের কাজের জন্য দেশ-বিদেশের সম্মান লাভ করেছেন আলি। ১৯৭১ খ্রিঃ পরিবেশ বিষয়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পল গেটি অ্যাওয়ার্ড লাভ করেছেন তিনি। পুরস্কারের পঞ্চাশ হাজার ডলারের প্রায় সম্পূর্ণ অংশই তিনি দান করেছেন মুম্বাই ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটিতে।

সালিম আলী ‘র মৃত্যু: Salim Ali’s Death

জীবনের শেষ প্রান্তে ১৯৭১ খ্রিঃ অসুস্থ অবস্থায় আলি যখন হাসপাতালে ছিলেন, তখনও তার নিত্যসঙ্গী প্রিয় বাইনোকুলারটি শিয়রের কাছে থাকত। জানালার ফাকে উকি দেওয়া কোন পাখি যাতে তার চোখে ফাঁকি দিতে না পারে সেজন্য সর্বদাই প্রস্তুত থাকতেন সেলিম আলি, সেই একানব্বই বছর বয়সেও।

Leave a Comment