রাজচন্দ্র বসু জীবনী – Raj Chandra Bose Biography in Bengali

রাজচন্দ্র বসু জীবনী: আজ আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছি মহান ব্যক্তিদের জীবনী সমগ্র। মহান ব্যক্তি আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা। তাঁদের জীবনের ক্ষুদ্রতম অংশগুলি আমাদের জন্য শিক্ষামূলক হতে পারে। বর্তমানে আমরা এই মহান ব্যক্তিদের ভুলতে বসেছি। যাঁরা যুগ যুগ ধরে তাদের কর্ম ও খ্যাতির মধ্য দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন এবং জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প ও সাহিত্যের জগতে এক অনন্য অবদান রেখেছেন এবং তাঁদের শ্রেষ্ঠ গুণাবলী, চরিত্র দ্বারা দেশ ও জাতির গৌরব বৃদ্ধি করেছেন। সেইসব মহান ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম বিজ্ঞানী রাজচন্দ্র বসু (Raj Chandra Bose) -এর সমগ্র জীবনী সম্পর্কে এখানে জানব।

রাজচন্দ্র বসু জীবনী – Raj Chandra Bose Biography in Bengali

নামরাজচন্দ্র বসু
জন্ম১৯ জুন ১৯০১
জাতীয়তাভারতীয়
নাগরিকত্বমার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
মাতৃশিক্ষায়তনকলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
কর্মক্ষেত্রগণিত পরিসংখ্যান
প্রতিষ্ঠানসমূহকলোরাডো স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়, ক্যাপেল হিল
মৃত্যু৩১ অক্টোবর ১৯৮৭ (বয়স ৮৬)

রাজচন্দ্র বসু কে ছিলেন? Who is Raj Chandra Bose?

ভারতীয় বিজ্ঞান সাধনার অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র রাজচন্দ্র বসু সারা পৃথিবীকে চমৎকৃত করেছিলেন গণিত ও পরিসংখ্যানের ক্ষেত্রে তাঁর নতুন নতুন আবিষ্কারের দ্বারা। বিশ্ববিজ্ঞানের ইতিহাসে তাঁর কীর্তি স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে।

রাজচন্দ্র বসু এর জন্ম: Raj Chandra Bose’s Birthday

মধ্যপ্রদেশের হোসাঙ্গাবাদ শহরে ১৯০১ খ্রিঃ ১৯শে জুন জন্ম হয় রাজচন্দ্রের।

রাজচন্দ্র বসু এর পিতামাতা ও জন্মস্থান: Raj Chandra Bose’s Parents And Birthplace

তাঁর পিতা ছিলেন চিকিৎসক। পুত্রের জন্মের কিছুদিন পরেই তাঁকে কর্মসূত্রে চলে আসতে হয় রোটাক শহরে। রাজচন্দ্রের ছেলেবেলা এখানেই অতিবাহিত হয়৷

স্বচ্ছল পরিবারের প্রথম সন্তান রাজচন্দ্র। তাই শৈশবকালটা ভালভাবেই কেটেছিল তাঁর।

রাজচন্দ্র বসু এর শিক্ষাজীবন: Raj Chandra Bose’s Educational Life

পড়াশুনায় গভীর আগ্রহ ছিল তাঁর। ছিল অসাধারণ মেধা। তাই স্কুলে ছাত্র শিক্ষক সকলেরই প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেছিলেন তিনি।

পড়াশুনার বিষয়ের মধ্যে অঙ্কের প্রতিই সবচেয়ে ঝোঁক রাজচন্দ্রের। তাই বলে অন্য বিষয়ে যে পিছিয়ে ছিলেন তা নয়। ক্লাসের সব পরীক্ষাতেই সব বিষয়ে সব সেরা নম্বর থাকে তাঁর।

ভবিষ্যতে এই ছেলেই যে স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করবে এ বিষয়ে শিক্ষকমশাইদের কারো সংশয় ছিল না।

একবার স্কুলের পরীক্ষায় সব বিষয়ে ক্লাসে সর্বোচ্চ নম্বর থাকলেও ভূগোলে হলেন দ্বিতীয়। মর্মাহত হন রাজচন্দ্র চিন্তিত হন রাজচন্দ্রের পিতা। ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তিনি দিনকতক রোগী দেখা বন্ধ করলেন। ছেলেকে নিয়ে বসলেন ভূগোল শেখাতে।

গল্পে গল্পে দিন কয়েকের মধ্যেই ভূগোলের গোটা বইটির সঙ্গে তিনি পরিচয় করিয়ে দেন ছেলের। সেবার বার্ষিক পরীক্ষায় দেখা গেল রাজচন্দ্র ভূগোলে প্রথম স্থানটি ফিরে পেয়েছেন ।

স্কুলের শেষ পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল করে স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করলেন রাজচন্দ্র। যথানিয়মে বৃত্তি লাভ করলেন। ভর্তি হলেন বি. এ. ক্লাসে।

রাজচন্দ্র বসু এর ছেলেবেলা: Raj Chandra Bose’s Childhood

ছেলেবেলা থেকে অঙ্কের সঙ্গেই অন্তরঙ্গতা গড়ে উঠেছিল বেশি। সেই বিশুদ্ধ অঙ্ক নিয়ে চলল কলেজের পাঠও। অঙ্কে চমকপ্রদ নম্বর পেয়ে বি. এ. পরীক্ষা সসম্মানে উত্তীর্ণ হলেন।

এই সময়টা বাস্তবের কঠোর আঘাতে বিপর্যস্ত হতে হয়েছে রাজচন্দ্রকে। প্রবল মনোবল আর উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে সমস্ত প্রতিকূলতার সঙ্গে সমানে মুখোমুখি লড়াই করে গেছেন তিনি।

বি. এ. ক্লাসে ভর্তি হবার আগেই আকস্মিক রোগ ভোগে কিছুদিনের ব্যবধানে বাবা মা দুজনেই গত হয়েছিলেন। নাবালক একটি ভাই ও দুটি বোনের সম্পূর্ণ দায়দায়িত্ব এর পর থেকে বহন করতে হয়েছে তাঁকেই। সংসারের বড় সন্তান যে তিনি।

পিতা সঞ্চয় যা রেখে গিয়েছিলেন অল্পদিনেই তা নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। একদিকে ছোট ভাইবোনদের দায়িত্ব অন্যদিকে নিজের কলেজের পড়াশুনা। কাজেই বাধ্য হয়ে নিতে হয়েছে প্রাইভেট টিউশান। ভাইবোনদের যাতে কোনদিকে অসুবিধা না হয় সেদিকে সদা সতর্ক নজর।

আরও পড়ুন: শ্রীনিবাস রামানুজন জীবনী

নিজের সুবিধা অসুবিধার কথা ভুলে গিয়ে কেবল কলেজের পড়াটা ঠিক রেখেছেন। আর বাকি সময়টা কাটিয়েছেন ছাত্র পড়িয়ে।

এভাবেই কোনমতে তিনি বড় করে তুলেছেন ভাইবোনদের। নিজে পাস করলেন বি. এ. পরীক্ষা।

১৯২৫ খ্রিঃ বি. এ. পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে রাজচন্দ্র চলে এলেন দিল্লিতে। সেখানে নাম লেখালেন এম. এ. ক্লাসে।

এখানে বিশুদ্ধ গণিত পড়াবার কোন ব্যবস্থাই ছিল না। অথচ বিশুদ্ধ গণিতই তাঁর প্রিয় বিষয়- প্রাণবায়ুর মতোই। অগত্যা ফলিত গণিতের ক্লাসই করতে লাগলেন।

মনে অতৃপ্তি। ভবিষ্যতের স্বপ্নও তিনি দেখতেন বিশুদ্ধ গণিত নিয়েই। তবুও পরীক্ষায় বরাবরের মত ভাল ফলই করলেন। কিন্তু মনে শান্তি নেই- বিশুদ্ধ গণিতের উচ্চতর পাঠ নিতে পারছেন না বলে। আকস্মিক ভাবেই এসময়ে ইচ্ছাপূরণের একটা সুযোগ পেয়ে গেলেন তিনি।

দিল্লিতে রাজচন্দ্র অঙ্ক শেখাতেন বিশিষ্ট ধনী শেঠ কেদারনাথ গোয়েঙ্কার ভাইকে। একদিন কেদারনাথ ডেকে পাঠালেন রাজচন্দ্রকে। দেখা করতেই তিনি জানালেন, রাজচন্দ্র যদি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশুদ্ধ গণিতে এম. এ. পড়াতে চান তাহলে তিনি তাঁকে আর্থিক সাহায্য করতে প্রস্তুত আছেন।

কেদারনাথের এই প্রস্তাবে যেন হাতে চাঁদ পেলেন রাজচন্দ্র। মনস্থির করতে দ্বিধা হল না। কদিন পরেই তিনি কেদারনাথের সঙ্গে কলকাতা চলে এলেন। বিশুদ্ধ গণিতের উচ্চশিক্ষায় আকাঙ্ক্ষা ছিল রাজচন্দ্রের। এবারে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হল সেই পর্ব।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করার পাশাপাশি কলকাতায় প্রথমে কিছুকাল প্রাইভেট টিউশনও করতে হয়েছিল রাজচন্দ্রকে। ভাইবোনদের জন্য বাড়িতে নিয়মিত টাকা পাঠাতে হত সেই টিউশনের উপার্জন থেকে।

সৌভাগ্যবশতঃ আর্থিক দুর্ভাবনার অনেকটাই লাঘব হল আকস্মিক একটা সুযোগ পেয়ে।

রাজচন্দ্র বসু এর অবদান: Contribution of Physician Raj Chandra Bose

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত-গবেষক শ্যামদাস মুখার্জির সঙ্গে পরিচয় হল রাজচন্দ্রের। তাঁর প্রতিভার পরিচয় পেয়ে গণিত বিজ্ঞানী শ্যামদাস মুগ্ধ হলেন। আর্থিক অনটনের পাকে পড়ে এমন প্রতিভার যাতে অপচয় না হয়, সেই জন্য তিনি রাজচন্দ্রকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিলেন। একটি ঘর ছেড়ে দিলেন তাঁর থাকার জন্য। নিজের ছিল অঙ্কের এক বিশাল লাইব্রেরী। রাজচন্দ্রকে অনুমতি দিলেন সেই লাইব্রেরী ব্যবহারের।

শ্যামদাসের সাহায্য ও তত্ত্বাবধানে রাজচন্দ্রের জীবনের মোড় পরিবর্তিত হয়। তিনি নিজের বিশুদ্ধ গণিতের গবেষণায় একান্তভাবে মনোনিবেশ করার সুযোগ পান।

১৯২৭ খ্রিঃ বিশুদ্ধ গণিতে প্রথম শ্রেণী পেয়ে এম. এ পাস করলেন রাজচন্দ্র। এভাবে পড়াশুনার একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হল। তিনি চাকরির সন্ধানে উঠে পড়ে লাগলেন।

আরও পড়ুন: পিথাগোরাস এর জীবনী

কিন্তু কলকাতা শহরে চষে ফেলেও একটা সামান্য কেরানির চাকরিও জোটাতে পারলেন না তিনি। যেখানেই যান সেখানেই শুনতে হয়, তিনি চাকরির পদের তুলনায় অতিরিক্ত যোগ্য ।

অগত্যা সেই টিউশনির একঘেয়ে জীবনেই বহাল থাকতে হয়! নিজের এবং পরিবারের গ্রাসাচ্ছাদনের প্রয়োজন উপেক্ষা তো করতে পারেন না।

সমস্ত দিনের কর্মব্যস্ততার মধ্যেও বিশুদ্ধ গণিত নিয়ে তাঁর ভাবনা চিন্তার অন্ত নেই। পৃথিবীর বিশিষ্ট গণিতবিদদের অবদান তাঁর মন জুড়ে রয়েছে। সারাক্ষণ একই কথা কেবল মনে উদয় হয়, তিনিও কি বিশুদ্ধ গণিতে কোন অবদান রেখে যেতে পারেন না?

এসব কথা যত ভাবেন ততই আরও গভীর হয় তাঁর গবেষণা। এই সময় রাজচন্দ্র জ্যামিতি নিয়েই চিন্তা ভাবনা করেছেন বেশি।

এই ভাবেই যেতে থাকে সময়। একসময় কলকাতার আশুতোষ কলেজে অঙ্কের অধ্যাপকের কাজও জুটে যায়। কিন্তু খুব বেশি দিন সেখানে কাজ করতে হয়নি।

তত দিনে সৌভাগ্যলক্ষ্মী মুখ তুলে তাকিয়েছেন। তাঁর জীবনের ধ্যান-জ্ঞান বিশুদ্ধগণিতের গবেষণার সব চেয়ে বড় সুযোগ পেয়ে যান তিনি।

সেই সময় সবে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনসটিটিউট। ভুবন বিখ্যাত পরিসংখ্যানবিজ্ঞানী প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ সেই প্রতিষ্ঠানের প্রাণপুরুষ।

ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খুঁজে খুঁজে তিনি সেখানে নিয়ে আসছেন প্রতিভাবান পরিসংখ্যান বিজ্ঞানীদের। তাঁর তত্ত্বাবধানেই ঘটছে তাঁদের প্রতিষ্ঠা এবং নবপ্রতিষ্ঠিত পরিসংখ্যান ভবনের সমৃদ্ধি।

একসময়ে তাঁর নজর পড়ল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত রাজচন্দ্রের প্রতি। গুণগ্রাহী প্রশান্তচন্দ্র সাদরে তাঁকে আহ্বান জানালেন।

অন্য যে কেউ প্রশান্তচন্দ্রের আহ্বানে ইতস্ততঃ না করে পরিসংখ্যান ভবনের চাকরিতে যোগ দিত, তাতে কোন সংশয় নেই। কিন্তু রাজচন্দ্র তা পারলেন না। অথচ এমন একটি চাকরি পাওয়ার অর্থ তাঁর কাছে তখন হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো।

রাজচন্দ্রের ইতস্ততঃ করার কারণ হল, তিনি ছিলেন বিশুদ্ধ গণিত ও জ্যামিতি-গবেষক। পরিসংখ্যানের ক্ষেত্রে গণিতের প্রয়োজন থাকলেও জ্যামিতির সঙ্গে তার কোন সম্বন্ধ নেই। তাছাড়া পরিসংখ্যানের কোন পাঠই তাঁর ছিল না। বলতে গেলে এ বিষয়ে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ অজ্ঞ।

এই সাত-পাঁচ ভেবে তিনি পিছিয়ে ছিলেন। মহলানবিশ জানতে পেরে রাজচন্দ্রকে আশ্বাস দিয়ে বলেন তাঁর ভয় অমূলক। পরিসংখ্যানের প্রাথমিক ধারণা যেটুকু দরকার তিনিই তাঁকে শেখাবেন।

আশ্বস্ত হয়ে রাজচন্দ্র এবারে মুক্ত মন নিয়ে স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনসটিটিউটের কাজে যোগদান করলেন।

এখানে ঢুকে এক নতুন জগতের সন্ধান পেলেন রাজচন্দ্র। পরিসংখ্যানের বইপত্র যত নাড়াচাড়া করেন ততই তার মধ্যে তলিয়ে যেতে থাকেন। প্রশান্তচন্দ্রের ক্লাস করে তাঁর আগ্রহ ও মনোযোগ আরও বৃদ্ধি পায়। এই ভাবে চলতে থাকে পড়াশুনা, প্রশান্তচন্দ্রের ক্লাস করা আর অন্য দিকে ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস নেন নিজে। আপ্রাণ চেষ্টায় পরিসংখ্যানের সমস্ত বিষয়ই তাদের কাছে পরিষ্কার করে তুলে ধরেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই অধ্যাপক হিসাবেও ছাত্রমহলে তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।

রাজচন্দ্র বসু এর কর্ম জীবন: Raj Chandra Bose’s Work Life

১৯৪০ খ্রিঃ ভারতীয় পরিসংখ্যান ভবনের কাজ ছেড়ে রাজচন্দ্র যোগ দেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে এতদিনে চালু হয়েছে পরিসংখ্যানের নতুন বিভাগ। রাজচন্দ্র হলেন সেই নতুন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক।

রাজচন্দ্র বসু এর দেশ ত্যাগ: Rajchandra Basu’s country to leave

১৯৪৭ খ্রিঃ ১৫ই আগস্ট ভারত স্বাধীন হল। নতুন ভারত গড়ার সংকল্প নিয়ে দেশের সর্বস্তরেই তৎপরতা শুরু হল। বিজ্ঞানীরা যখন উন্নয়নমূলক নতুন নতুন প্রকল্প রচনায় নিজেদের নিয়োজিত করলেন সেই সময় আকস্মিকভাবেই দেশ ত্যাগ করলেন রাজচন্দ্র।

১৯৪৭ খ্রিঃ তখন তাঁর বয়স আটচল্লিশ বছর, রাজচন্দ্র পাড়ি জমালেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।

তাঁর এই দেশত্যাগকে অনেকে অনেক ভাবে ব্যাখ্যা করলেও প্রকৃত সত্য হল, বিশুদ্ধ গণিতের গবেষণায় তিনি এমনই বিভোর হয়ে পড়েছিলেন যে গবেষণার বৃহত্তর সুযোগের সন্ধানে তাঁকে আমেরিকা যাত্রা করতে হয়েছিল।

যেই সুযোগ দেশে ছিল না, অদূর ভবিষ্যতে তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাও ছিল সুদূর পরাহত, তার সন্ধানেই জ্ঞানভিক্ষু রাজচন্দ্রকে বাধ্য হয়েই দেশ ছেড়ে যেতে হয়েছিল।

প্রার্থিত সুযোগ তিনি পেয়েওছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরিসংখ্যান বিভাগে প্রধান অধ্যাপকের পদে তাঁকে নিয়োগ করা হল।

এখানে একান্ত এবং বৃহত্তর সুযোগ সুবিধার মধ্যে তাঁর গণিতের গবেষণা অল্প সময়ের মধ্যেই আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছে গেল। পৃথিবীর তাবড় গণিতবিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হল তাঁর প্রতি।

নর্থ ক্যারোলিনায় কিছুকাল চাকরি করার পর রাজচন্দ্র চলে এলেন কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ে। একসময়ে তিনি পরিদর্শক প্রধান অধ্যাপক রূপে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও কাজ করেছেন।

১৯৭৬ খ্রিঃ গণিত গবেষণায় অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতি তিনি পান আমেরিকা থেকেই। তিনি মার্কিন বিজ্ঞান অ্যাকাডেমির সদস্য নির্বাচিত হন।

রাজচন্দ্র বসু এর আবিষ্কার: Discovery by Raj Chandra Bose

বিশ্বগণিতের ইতিহাসে রাজচন্দ্রের দুটি জগৎ বিখ্যাত আবিষ্কার হল- (১) গত শতকের সুখ্যাত সুইস গণিতবিজ্ঞানী লিওনার্ড ইউলারের গাণিতিক কনজেকচার বা অনুমানের ভুল সংশোধন এবং (২) টেলিযোগাযোগ সংক্রান্ত। এছাড়া জ্যামিতির ক্ষেত্রেও তাঁর বহুমাত্রিক জ্যামিতির তত্ত্বটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে। এই তত্ত্ব বোস-ব্লাৎকে তত্ত্ব নামে বিখ্যাত।

বিখ্যাত সুইস গণিতবিদ লিওনার্ড ইউলার একটি বর্গ নিয়ে গাণিতিক অনুমান নির্মাণ করেছিলেন। তাকে বলা হত ইউলারের ম্যাজিক বর্গ। এই বর্গের লম্বালম্বি ও আড়াআড়ি দুদিকেই ঘরের সংখ্যা সমান। এই ঘরগুলোতে ল্যাটিন, গ্রিক বা যে কোনও ভাষার অক্ষর যদি মাত্র একবার করে বসানো যায় তাহলে লম্বালম্বি ও আড়াআড়ি দুদিক থেকেই তা সমান হবে। ১ থেকে ৯ পর্যন্ত সংখ্যাগুলো যদি ইউলারের নিয়ম অনুযায়ী বর্গের ঘরগুলোতে সাজানো যায় তবে লম্বালম্বি ও আড়াআড়ি উভয়দিকেই সংখ্যার মোট যোগফল দাঁড়ায় ১৫।

এই বর্গ যদি ৩×৩ শ্রেণীতে সাজানো যায় তাহলে সম্ভাব্য ঘর সংখ্যা হয় (৩) ৩×৩= (৩) ৯=১৯৬৮৩ । বর্গটি তৈরি করার সময় ইউলার গ্রিক ও ল্যাটিন অক্ষর বসিয়েছিলেন। এই কারণে এই বর্গটির নাম হয় গ্রিক-ল্যাটিন বর্গ। একসময়ে ইউলারকে দেওয়া হয়েছিল একটি সমস্যা- বিভিন্ন পদের ছত্রিশ জন সামরিক অফিসার নিয়ে ছয়টি বিভিন্ন রেজিমেন্টে বর্গাকারে সাজাতে হবে।

ইউলার কিছুতেই এই সমস্যার জট খুলতে না পারলেও তিনি বলেন এই ধরনের বর্গ তৈরি করতে হলে সংখ্যাগুলো হওয়া দরকার বিজোড় নয়তো দ্বি জোড়। আর জোড় সংখ্যাটি এমন হতে হবে যা সব সময়েই ৪ সংখ্যাটি দ্বারা বিভাজ্য হবে। অর্থাৎ সংখ্যাগুলো হতে হবে ৪, ৮, ১২, ১৬ ………. ইত্যাদি।

ইউলার জানান “I do not hesitate to conclude that it is impossible to produce any complete Graceatain square of 6×6=36 cells and the same impossibility extinds to the cases of squares of 10, 14 and in general to all single even number of rows and columns.”

রাজচন্দ্র ও তাঁর দুই ছাত্র শ্রীখণ্ডি ও পার্কার ইউলারের এই গাণিতিক ‘অনুমানটিকে ভুল প্রমাণ করেন। তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রুপ থিয়োরি বা বিন্যাসতত্ত্ব ব্যবহার করে প্রমাণ করেন ২x২ ধরনের বর্গ কখনো তৈরি হয় না। তথাকথিত জাদু বর্গ তৈরি শুরু হয় ৩ সংখ্যা থেকে এবং সেক্ষেত্রে ৩×৩ হারে এই বর্গ ৩৬২৮৮২ ভাবে তৈরি করা সম্ভব হবে।

রাজচন্দ্রের কৃতিত্ব কেবল এখানেই নয়। ইউলারের জাদুবর্গকে তিনি বৃহত্তর গবেষণার ক্ষেত্রে প্রয়োগের পদ্ধতিও উদ্ভাবন করেন এবং তাঁর দ্বারা জাদুবর্গের সংশোধিত রূপটি ফলিত জীববিজ্ঞান তথা জেনেটিক্সে, কৃষিবিজ্ঞানে, চিকিৎসাবিদ্যায়, জীববিদ্যা ও সমাজবিদ্যার নানা গবেষণার ক্ষেত্রে প্রয়োগ হতে থাকে।

রাজচন্দ্রের অপর বিশ্বখ্যাত গবেষণাটি টেলিযোগাযোগ সংক্রান্ত

ইতালির আবিষ্কারক মার্কনির আবিষ্কার সংবাদ প্রেরণের টেলিব্যবস্থার আমূল সংস্কার সাধন করেছিলেন এম. এফ. বি মর্স নামে এক বিজ্ঞানী। মর্স প্রবর্তিত Morse code বা সঙ্কেত পদ্ধতি আধুনিক টেলিযোগাযোগের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তাতে নির্দিষ্ট সিকোয়েন্সে ডট (.) বা ড্যাশ (—) চিহ্ন দুটি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ব্যবহারিক ক্ষেত্রে প্রায়শই এই দুটি চিহ্ন নিয়ে গোলযোগ সৃষ্টি হয়। ড্যাশ (—) আর ডট (.) পাল্টাপাল্টি হয়ে গিয়ে তারবার্তায় গোলমাল ঘটিয়ে দেয়। দেখা যায় সাধারণতঃ তারবার্তা প্রেরণের ক্ষেত্রে প্রতি সেকেণ্ডে ডট (.) বা ড্যাশ (—) -এর ব্যবহার হয় ১৫০০ থেকে ২০০০ বার। কিন্তু প্রতি এক লক্ষ ড্যাশ (—) বা ডট (.) একই হারে বিভ্রাট সৃষ্টি করে অর্থাৎ প্রতি মিনিটে একটি করে।

রাজচন্দ্র বসু তাঁর পরিকল্পিত জ্যামিতি ও বিন্যাসতত্ত্বের সাহায্যে এমন এক পদ্ধতি গড়েন যার ফলে টেলিযোগাযোগের সঙ্কেত পদ্ধতিগত কোনও বিভ্ৰাটই ‘আর রইল না।

তবে কেবল একটি বিভ্রাট ঘটবে ৩০০ বছর পরে। রাজচন্দ্রকৃত মর্স-কোড সংশোধন ম্যাসাচুসেটস ইনসটিটিউট অব টেকনোলজির লিঙ্কন ল্যাবরেটরিতে সর্বপ্রথম কাজে লাগান হয় এবং অসাধারণ সাফল্য পাওয়া যায়।

টেলিযোগাযোগের সঙ্কেত পদ্ধতির মর্স কোড-এর বৈপ্লবিক সংস্কার সাধন করে রাজচন্দ্র জগৎ জোড়া পরিচিতি লাভ করেন।

জ্যামিতির ওপর গবেষণায় রাজচন্দ্র সুখ্যাত হন। তাঁর মাল্টি-ডাইমেনশনাল জিওমেট্রি বা বহুমাত্রিক জ্যামিতিক তত্ত্বটি বোস-ব্লাৎকে তত্ত্ব নামে পরিচিত এবং গণিত বিজ্ঞানীদের নবতর সত্যসন্ধানের সহায়ক।

রাজচন্দ্র বসু এর পুরস্কার ও সম্মান: Raj Chandra Bose’s Awards And Honors

রাজচন্দ্রের গণিত গবেষণার স্বীকৃতি জানিয়ে ১৯৪৭ খ্রিঃ মার্কিন বিজ্ঞান একাডেমী তাঁকে মাননীয় সদস্য পদে নির্বাচিত করেন।

প্রাচীন ভারতের আর্যভট্টের কাল থেকে ভারতীয় গণিত গবেষণার যে ধারা প্রবহমান রাজচন্দ্রের মনীষা তার বিস্ময়কর আধুনিক রূপ বিশ্ববাসীর দরবারে উপস্থাপন করে স্বদেশের গৌরব বৃদ্ধি করেন।

Leave a Comment