Christopher Columbus Biography in Bengali – ক্রিস্টোফার কলম্বাস জীবনী

Christopher Columbus Biography– আজ আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছি মহান ব্যক্তিদের জীবনী সমগ্র। মহান ব্যক্তি আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা। তাঁদের জীবনের ক্ষুদ্রতম অংশগুলি আমাদের জন্য শিক্ষামূলক হতে পারে। বর্তমানে আমরা এই মহান ব্যক্তিদের ভুলতে বসেছি। যাঁরা যুগ যুগ ধরে তাদের কর্ম ও খ্যাতির মধ্য দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন এবং জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প ও সাহিত্যের জগতে এক অনন্য অবদান রেখেছেন এবং তাঁদের শ্রেষ্ঠ গুণাবলী, চরিত্র দ্বারা দেশ ও জাতির গৌরব বৃদ্ধি করেছেন। সেইসব মহান ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম নৌঅভিযাত্রী ক্রিস্টোফার কলম্বাস (Christopher Columbus) -এর সমগ্র জীবনী সম্পর্কে এখানে জানব।

Table of Contents

Christopher Columbus Biography in Bengali- ক্রিস্টোফার কলম্বাস জীবনী

নামক্রিস্টোফার কলম্বাস
জন্ম৩১ অক্টোবর ১৪৫১ খ্রিঃ
জন্মস্থানজেনোয়া, ইতালী
পেশানৌঅভিযাত্রী
দাম্পত্য সঙ্গীফিলিপা মনিজ পেরেস্টেরো
কাজের মেয়াদইন্ডিজের গভর্নর (১৪৯২ – ১৪৯৯)
মৃত্যু২০ মে ১৫০৬ খ্রিঃ

ক্রিস্টোফার কলম্বাস কে ছিলেন? Who is Christopher Columbus?

সাধারণ এক তন্তুবায়ের ছেলে ক্রিস্টোফার কলম্বাস কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায় বলে লাভ করেছিলেন দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ নাবিকের সম্মান। পৃথিবীর ভৌগোলিক ইতিহাসের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য হয়ে আছে তাঁর অভিযান কাহিনী।

ক্রিস্টোফার কলম্বাস এর জন্ম: Christopher Columbus’s Birthday

কলম্বাসের জন্ম সময় ও তারিখ নিয়ে যথেষ্ট মতবিরোধ রয়েছে। তবে অনুমান করা হয় ১৪৫১ খ্রিঃ আগস্ট থেকে অক্টোবরের মধ্যে কোন একদিন জন্ম হয়েছিল তাঁর।

ক্রিস্টোফার কলম্বাস এর পিতামাতা ও জন্মস্থান: Christopher Columbus’s Parents And Birth Place

সাধারণ এক তাঁতী পরিবারে জন্মেছিলেন কলম্বাস। কাপড়ের ব্যবসার সূত্রে পরিবারটি ছিল যথেষ্ট সচ্ছল। তাই সুখের মধ্যেই লালিত-পালিত হয়েছিলেন তিনি।

ছেলেবেলাতেই তিনি ব্যবসায়ীদের মুখে সোনার দেশ ভারতবর্ষের উৎকৃষ্ট পোশাক, বিভিন্ন মশলা ও বিপুল ধনসম্পদের কথা জানতে পেরেছিলেন। তাই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন, তিনিও একদিন ভারতবর্ষে গিয়ে জাহাজ বোঝাই করে সোনা-রুপো, হীরে মণিমানিক্য নিয়ে আসবেন।

ক্রিস্টোফার কলম্বাস এর প্রথম জীবন: Christopher Columbus’s Early Life

ছেলেবেলা থেকে এই স্বপ্নই হয়ে উঠেছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান, এককথায় ভাবনা-কল্পনার চালিকাশক্তি।

জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যামিতি ও লাতিন ভাষা শিক্ষার পাশাপাশি কিশোর বয়স থেকেই বাবাকে ব্যবসার কাজে নিয়মিত সাহায্য করতেন কলম্বাস। তাঁর প্রিয় বিষয় ছিল ভূগোল।

দেশ-বিদেশের বিবরণ পড়ে তাঁর স্বপ্নচারী মন অ্যাডভেঞ্চারের আনন্দে উতলা হয়ে উঠত।

কলম্বাস নিজে যে আত্মকাহিনী রচনা করেছেন তা থেকেও তাঁর কিশোর বয়স সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। বস্তুতঃ তাঁর জীবনের প্রথমার্ধ, আটাশ বছরের আগে পর্যন্ত অনেক বিষয়ই অজানা থেকে গেছে।

যতদূর জানা গেছে তাতে দেখা যায়, তাঁর বাবা ব্যবসায়ে সর্বস্বান্ত হলে তাঁদের পরিবার অভাব অনটনের কবলিত হয়। তখন বাধ্য হয়েই কলম্বাসকে অর্থ উপার্জনের চেষ্টায় নামতে হয়।

ক্রিস্টোফার কলম্বাস মানচিত্র তৈরি করতে শেখা

বাবার এক বন্ধুর কাছে মানচিত্র তৈরি করতে শিখেছিলেন তিনি। এই সময়ে ছোট ছোট মানচিত্র তৈরি করে পথে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করতেন।

অনুমান করা হয়, এই সময়েই কোনও জাহাজে চাকরি নিয়ে তিনি সমুদ্র অভিযানের অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন। জীবনের প্রয়োজনেই কষ্টসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তাই সমস্ত রকম প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে সমর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রে তাঁর ভাগ্য ছিল নিতান্তই বিরূপ।

সেই সময়ে কলম্বাসের ভাই বাস করতেন লিসবন শহরে। জীবিকার্জনের আশায় ভাইয়ের কাছে এসেই উঠলেন কলম্বাস শেষ পর্যন্ত। তখন তিনি আটাশ বছরের যুবা।

ভাইয়ের চেষ্টায় অল্প কিছুদিনের মধ্যেই লিসবনে একটা কাজও পেয়ে গেলেন কলম্বাস। প্রায়ই তিনি যেতেন গীর্জায়। সেখানেই একদিন আলাপ হল ফেলিপা মোইস দ্য পেরেস্ত্রেল্লো নামে এক তরুণীর সঙ্গে।

ফেলিপার বাবা বার্থোলোমিউ ছিলেন সম্রাট হেনরির নৌবাহিনীর পদস্থ অফিসার।

ক্রিস্টোফার কলম্বাস এর পরিবার: Christopher Columbus’s family

ফেলিপার সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রেই কলম্বাসের জীবনের পটপরিবর্তনের সূত্রপাত হল। কিছুদিনের মধ্যেই দুই তরুণ-তরুণীর সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হল এবং ফেলিপা ও কলম্বাস বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন।

বিবাহের পর শ্বশুর গৃহেই থিতু হলেন কলম্বাস। এই সময় পরিবারের লাইব্রেরীতে বসে তিনি পড়তেন দেশ-বিদেশের ভ্রমণ-কাহিনী।

তাছাড়া শ্বশুরের কাছে শুনতে পেতেন তাঁর জীবনের সমুদ্র অভিযানের নানা রোমাঞ্চকর কাহিনী।

ভবিষ্যৎ অভিযাত্রী কলম্বাসের মানসিক প্রস্তুতি এইভাবে পরিপুষ্ট হতে লাগল!

একদিন তাঁর হাতে পড়ল মার্কো পোলোর চীন ভ্রমণের বৃত্তান্ত। সেই কাহিনী পড়ে প্রাচ্যদেশে অভিযানের আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়ে উঠল তাঁর মনে।

প্রাচ্যদেশে পথেঘাটে ছড়িয়ে থাকে সোনা-রুপো, হীরে। অফুরন্ত সম্পদ সেখানে। ইচ্ছে করলেই সেসব জাহাজ বোঝাই করে নিয়ে আসা যায়। প্রাচ্য দেশ সম্পর্কে তখন এমন ধারণাই গড়ে উঠেছিল লোকের মনে।

ক্রিস্টোফার কলম্বাস কেন বিখ্যাত ছিলেন

শৈশবেই এই জনশ্রুতির সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন কলম্বাস। মার্কো পোলোর ভ্রমণ-বৃত্তান্ত পড়ার পর অভিযানের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে তাঁর মনে জেগে উঠল তীব্র স্বর্ণতৃষ্ণা।

এবারে তাঁর ভাবনার মোড় ফিরল নতুন দিকে। মনের অভিলাষ পূর্ণ করতে হলে দরকার কয়েকটি জাহাজের, কী করে সংগ্রহ করা যায় সেসব? তাহলে প্রাচ্য দেশের সুগন্ধি মশলা আর তাল তাল সোনা নিয়ে আসার কোন বাধাই থাকে না।

ভাগ্যক্রমে এই সময় কলম্বাসের পরিচয় হয় এক বৃদ্ধ নাবিকের সঙ্গে। সেই নাবিক এক বাণিজ্য-জাহাজে করে পাড়ি দিয়েছিল দূর দেশে। ঝড়ে পথ হারিয়ে জাহাজ গিয়ে পড়েছিল এক অজানা দেশে।

জনপ্রাণীহীন মরুময় সে দেশ। জল নেই, খাদ্য নেই – ধু ধু করছে চারদিক। সেই দেশে থাকতে সাহস পায়নি তারা। তাই সেখান থেকে আবার দেশের পথ ধরল। শেষ পর্যন্ত যখন জাহাজ বন্দরে ভিড়ল, তখন জাহাজের অধিকাংশ লোকই প্রাণ হারিয়েছে। ভাগ্যক্রমেই প্রাণ বেঁচে গিয়েছিল সেই বৃদ্ধ নাবিকের। কলম্বাস এই অভিযান কাহিনী শুনে আশান্বিত হয়ে উঠলেন। তাঁর ধারণা হল সেই অজানা দেশই সোনায় মোড়া প্রাচ্য দেশ। সেই যুগের বিখ্যাত ভূগোলবিদ ছিলেন প্যাগোলো টোসকানেলি। স্বপ্নের প্রাচ্যভূমি সম্বন্ধে বিস্তারিত জানার জন্য কলম্বাস চিঠি লিখলেন প্যাগোলোর কাছে।

ক্রিস্টোফার কলম্বাসের কাহিনী

চিঠির উত্তরে তিনি কলম্বাসকে উৎসাহিত করে লিখলেন, তিনি যে দেশের স্বপ্ন দেখছেন, সেখানে সত্যি সত্যিই পথে ঘাটে ছড়িয়ে থাকে সোনা রুপো, হীরা, মণি, মাণিক্য।

সেই সোনার দেশে যাবার পথের একটি নক্সা তিনি তৈরি করেছেন। এই নক্সার সাহায্যে কলম্বাস স্বচ্ছন্দে পৌঁছে যেতে পারবেন প্রাচ্য ভূখন্ডে।

চিঠির সঙ্গে প্যাগোলোর পাঠানো নক্সাটি পেয়ে কলম্বাসের মনের সঙ্কল্প এবারে সিদ্ধান্তে রূপান্তরিত হল। তিনি যাত্রার তোড়জোড় আরম্ভ করলেন। কিন্তু কলম্বাসের চিন্তা ভাবনার সমর্থনে এগিয়ে এলো না একটি লোকও । সকলেই ব্যাপারটিকে অবাস্তব বলে উড়িয়ে দিল। এমন কি অনেক ক্ষেত্রেই তিনি হয়ে উঠলেন উপহাসের পাত্র।

কলম্বাস ছিলেন উদ্যমী পুরুষ। তাই এত সহজে হতাশ হলেন না। তিনি সরাসরি পর্তুগালের সম্রাট জনের দরবারে উপস্থিত হলেন এবং তাঁর পরিকল্পনার কথা প্রকাশ করলেন।

সম্রাট সব শুনলেন। কিন্তু কোন আগ্রহ প্রকাশ করলেন না। নিরাশ হয়ে ফিরে এলেন কলম্বাস।

কিন্তু হাতপা-গুটিয়ে বসে থাকলেন না। কিছুদিন পরেই তাঁর অভিযানে সাহায্য প্রার্থনা করে আবেদন জানালেন স্পেনের সম্রাট ফার্দিনান্দ এবং রানী ইসাবেলার কাছে।

ততদিনে ভাগ্য প্রসন্ন হয়েছিল কলম্বাসের। সম্রাট ফার্দিনান্দ তাঁর আবেদন অগ্রাহ্য করলেও রানী ইসাবেলার সহযোগিতার আশ্বাস পেলেন তিনি।

এই সময়ে আকস্মিক বিপর্যয় নেমে এলো কলম্বাসের জীবনে। দুশ্চিকিৎস্য ব্যাধিতে ভুগে অল্প দিনের মধ্যেই মারা গেলেন তাঁর স্ত্রী ফিলিপা। ফলে সাময়িক ভাবে কিছুদিনের জন্য স্থগিত রাখতে হল তাঁর পরিকল্পিত অভিযানের প্রস্তুতি। স্ত্রী বিয়োগ হওয়ায় কলম্বাসের পেছুটান বলতে কিছুই রইল না। তিনি তাই পূর্ণউদ্যমে তাঁর স্বপ্নকে সফল করার কাজে কোমর বেঁধে নেমে পড়লেন।

অভিযানের জন্য প্রয়োজন ছিল অর্থ, জাহাজ ও নাবিক। দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করার মতো দেশের প্রতিটি সম্ভ্রান্ত মানুষের কাছে আবেদন জানাতে লাগলেন তিনি ৷

সাহায্যের বিনিময়ে অফুরন্ত হীরে-জহরৎ দেবারও প্রতিশ্রুতি ছিল তাঁর। সেই সঙ্গে দাবি ছিল, যে দেশ তিনি আবিষ্কার করবেন, তাঁকে করতে হবে সেই দেশের ভাইসরয় আর দিতে হবে রাজস্বের একটা অংশ। দুঃখের বিষয়, সব জায়গাতেই প্রত্যাখ্যাত হলেন তিনি।

এই সময়টা খুবই সঙ্কটের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছিল তাঁর। অর্থের অভাবে প্রতিদিন নিয়মিত খাবারদাবারও জুটত না। অভাব-অনটনের সঙ্গে জুটেছিল হতাশার বেদনা। তাই প্রাচ্যদেশে অভিযানের পরিকল্পনা রূপায়নের আর কোন পথই ছিল না।

তবু দুর্মর আশায় ভর করে তিনি স্থির করলেন পর্তুগাল ছেড়ে ফ্রান্সে গিয়ে একবার শেষ চেষ্টা করবেন।

ঘটনাচক্রে এই সময়ে ফাদার পিরেজের সঙ্গে পরিচয় হল তাঁর। এই ভদ্রলোকের সঙ্গে রাজ পরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। রানী ইসাবেলা তাঁকে অত্যন্ত সম্মান করতেন।

কলম্বাসের পরিকল্পনার কথা জানতে পেরে ফাদার পিরেজ তাঁকে সাহায্যের জন্য রানী ইসাবেলাকে অনুরোধ করলেন।

কলম্বাসের অভিযানকে কেন্দ্র করে ফাদারেরও নিজস্ব একটি পরিকল্পনা জন্ম নিয়েছিল। অজানা দেশের বহু মানুষকে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করে অক্ষয় পুণ্য অর্জনের স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি।

এই সময় আরো কয়েকজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি কলম্বাসের সহায়তায় এগিয়ে এলেন। তারপর একদিন সম্রাটের দরবার থেকেও এলো আহ্বান।

কলম্বাসের কাছ থেকে তাঁর সম্পূর্ণ পরিকল্পনাটি পরিষ্কারভাবে জেনে নিলেন কৌতূহলী সম্রাট। তারপর ১৮৯২ খ্রিঃ ১৭ই এপ্রিল উভয় পক্ষের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হল।

স্থির হল কলম্বাসের আবিষ্কৃত নতুন দেশের শাসনভার দেওয়া হবে তাঁকে সেই সঙ্গে তিনি পাবেন অর্জিত সম্পদের এক দশমাংশ।

এতদিনে স্বপ্ন সফল করার পথ নিষ্কন্টক হল। সৌভাগ্যের উদয় হল কলম্বাসের জীবনে।

সম্রাটের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ পেয়ে অল্প দিনের মধ্যেই তিনটি জাহাজ নির্মাণ করালেন তিনি। জাহাজগুলোর নাম দেওয়া হল সান্তামারিয়া, পিটা ও নিনা।

জাহাজ তৈরির কাজ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হলেও নাবিক সংগ্রহের কাজটি সহজসাধ্য ছিল না।

অজানা অচেনা পথে পাড়ি দিতে হবে, কোনও দিন ফিরে আসা সম্ভব হবে কিনা সেই বিষয়টি ছিল অনিশ্চিত। তাই জীবনের ঝুঁকি নিতে সহজে কেউ রাজি হতে চাইল না। ইতিমধ্যে আরো কিছু বিশিষ্ট লোকের সাহায্য লাভ করলেন কলম্বাস। তাঁদেরই চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৮৪জন নাবিকও সংগ্রহ করা সম্ভব হল।

এবারে নিশ্চিন্ত হলেন কলম্বাস। ১৮৯২ খ্রিঃ ৩ আগস্ট নবনির্মিত তিনটি জাহাজে করে প্রয়োজনীয় রসদ ও অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে অজানা সমুদ্রের পথে ভেসে পড়লেন।

অফুরন্ত জলের রাজত্বে দিনের পর দিন কাটতে লাগল। জল ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না কোন দিকে। স্থলভূমির সন্ধানে ক্রমেই অধীর অশান্ত হয়ে উঠতে থাকে নাবিকেরা।

কলম্বাস তাদেব দেন সান্ত্বনা, শোনান উৎসাহের কথা, কিন্তু তাতেও কাজ হয় না। ধৈর্য হারিয়ে ফেলে নাবিকরা।

শেষ পর্যন্ত একদিন তারা বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসে – ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে জাহাজ দেশে।

এমনি সময়ে সকলের চোখ পড়ে সমুদ্রের জলে, ভেসে চলেছে একটি সবুজপাতার গাছের ডাল। বোঝা যায় নিকটেই রয়েছে স্থলভূমি।

কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের ইতিহাস

কলম্বাস বিক্ষুব্ধ নাবিকদের কাছে একটি মাত্র দিন চেয়ে নেন। সেই দিনটি ছিল ১২ই অক্টোবর। অবশেষে সহর্ষে লাফিয়ে উঠল নাবিকের দল। রোডারিগো নামে একজন নাবিক সর্বপ্রথম দিগন্তে দেখতে পেলেন স্থলের চিহ্ন।

১২ অক্টোবর দিনে বাহমা দ্বীপপুঞ্জের এক অজানা দ্বীপের মাটিতে পা রাখলেন কলম্বাস। তাঁর সঙ্গে জাহাজ থেকে নামলেন ক্যাপ্টেন মার্টিন আর ক্যাপ্টেন ভিসেন্ট। সকলেরই হাতে স্পেনের রাজকীয় সবুজ পতাকা।

সেই পতাকা মাটিতে পুঁতে কলম্বাস ঘোষণা করলেন, এতদিনে আমি ভারতবর্ষ আবিষ্কার করলাম।

প্রকৃতপক্ষে সেই দিন কলম্বাস যে দেশটি আবিষ্কার করেছিলেন, তা ভারতবর্ষ নয়, ছিল আমেরিকার একটি অংশ।

কলম্বাস যে দ্বীপে প্রথম পদার্পণ করেছিলেন তিনি তার নাম দিয়েছিলেন সান-সালভেদর। বর্তমানে নামকরণ হয়েছে ওয়েস্টলিং আইল্যান্ড।

৩ আগস্ট দিনটি আজও উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় কলম্বাস দিবস রূপে পালিত হয়ে থাকে।

কলম্বাসের ধারণা ছিল তিনি প্রাচ্যভূমি অর্থাৎ এশিয়া মহাদেশে এসে পৌঁচেছেন। যদিও তাঁর এই ধারণা ছিল ভ্রান্ত। তবে এই আবিষ্কারের মাধ্যমে তিনিই ইউরোপের মানুষের কাছে এক অজানা পৃথিবীর দ্বার প্রথম উন্মোচিত করেছিলেন।

অ্যাডভেঞ্চারের আকর্ষণ থাকলেও স্বর্ণসন্ধানই মূল উদ্দেশ্য। তাই নতুন ভূমিতে পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গেই চর্তুদিকে চলল অনুসন্ধান। কিন্তু মার্কো পোলোর বর্ণনার কোন মিলই পাওয়া গেল না কোনও দিকে। সোনাদানার বা হীরে মণির চিহ্নমাত্র নেই কোথাও।

ঘুরতে ঘুরতে অভিযাত্রী দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল একদল আদিবাসী মানুষের। তবে তাদের কথার একবর্ণও কলম্বাস বা তাঁর দলের কেউ বুঝতে পারলেন না।

এসত্ত্বেও দমলেন না তিনি। তাঁর দৃঢ় ধারণা হয়েছিল, মার্কো পোলো বর্ণিত সোনার দেশ কিপাংগু শহরেই পৌঁচেছেন তিনি। অবিলম্বেই অফুরন্ত সোনার ভান্ডারের সন্ধান পাবেন।

সান সালভেদরের পর কলম্বাস গেলেন কিউবা এবং হিস্পানিওয়ালা দ্বীপে। সাময়িক শিবির স্থাপন করলেন শেষোক্ত দ্বীপে। সেখানে ৪২ জন নাবিকের বসবাসের ব্যবস্থা করলেন। তারপর অবশিষ্ট সঙ্গীদের নিয়ে স্বদেশের পথে পাড়ি জমালেন।

তাঁর উদ্দেশ্য ছিল আরো লোকজন নিয়ে এসে এখানে ব্যাপকভাবে সোনার সন্ধান করবেন। যাবার সময় নতুন দেশে পৌঁছবার প্রমাণ হিসেবে সঙ্গে নিয়ে গেলেন স্থানীয় কিছু আদিবাসীকে।

অফুরন্ত সোনাদানা মণি-মাণিক্য সঙ্গে নিয়ে দেশে ফেরার কথা ছিল কলম্বাসের। কিন্তু তিনি ফিরেছিলেন শূন্য হাতে। তবুও নতুন দেশ আবিষ্কারের সুবাদে দেশে অভূতপূর্ব সংম্বর্ধনা লাভ করলেন তিনি।

কলম্বাসের সম্মানে রাজা রানী বিশেষ ভোজের আয়োজন করলেন। কলম্বাসকে আশীর্বাদ জানালেন স্বয়ং পোপ। তিনি ঘোষণা করলেন কলম্বাসের আবিষ্কৃত নতুন দেশ স্পেনের অন্তর্ভুক্ত হবে।

তারপর সম্রাট নিজেই নতুন এক অভিযানের আয়োজন করলেন। প্রস্তুত হল সুসজ্জিত নৌবহর, সংগৃহীত হল অসংখ্য লোকজন।

ক্রিস্টোফার কলম্বাস এর দ্বিতীয় সমুদ্র অভিযান

অবশেষে ১৪৯৩ খ্রিঃ ২৪ শে সেপ্টেম্বর কলম্বাসের নেতৃত্বে দ্বিতীয় সমুদ্র অভিযানের যাত্রা শুরু হল।

এবারে আর পথের অনিশ্চয়তা নেই। চেনা পথে দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পর তিনি এসে পৌঁছলেন হিস্পানিওয়ালা দ্বীপে।

সেখানে তখন তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল অভাবিত দৃশ্য। যে ৪২ জন নাবিক তিনি আস্তানায় রেখে গিয়েছিলেন তাদের অর্ধেক মারা গিয়েছিল অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে, অবশিষ্ট প্রাণ হারিয়েছিল স্থানীয় আদিবাসীদের হাতে। স্থানীয় আদিবাসীদের মন জয় করার জন্য ইউরোপীয়রা এমন ভান করেছিল যে বলিষ্ঠকায় সরল মানুষগুলো তাদের দেবদূত হিসাবে সম্মান ও আনুগত্য দেখিয়েছিল।

কিন্তু সাদা মানুষরা অল্পদিন পরেই জোর করে আদিবাসীদের নিজেদের দাসে পরিণত করতে লাগল। মেয়েদের হীন লালসা চরিতার্থ করার জন্য নির্যাতন করতে লাগল ৷

এসব কারণে স্বভাবতঃই ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল স্থানীয় আদিবাসীরা। একরাতে আক্রমণ চালিয়ে তারা নির্বিচারে হত্যা করল শ্বেত দেবতাদের। আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করল তাদের ডেরা।

দেখেশুনে সংযত হলেন কলম্বাস। তিনি আদিবাসীদের মন যুগিয়ে থেকে নানা দিকে ধনসম্পদের সন্ধান করতে লাগলেন।

এযাত্রায় নতুন কয়েকটি দ্বীপের সন্ধান পাওয়া ছাড়া আর কিছুই পেলেন না তিনি। অগত্যা নিজমূর্তি ধরলেন। আদিবাসীদের দাস হিসাবে বন্দী করে জাহাজ বোঝাই করে দেশে পাঠালেন।

ইউরোপের দেশগুলিতে দাস প্রথার প্রচলন থাকলেও দাসদের নিয়ে ব্যবসায়ের প্রচলন সেভাবে তখনও হয়নি।

তাই কলম্বাসের এই কাজের প্রচন্ড সমালোচনা হল। ইসাবেলা নিজেও পছন্দ করেননি কলম্বাসের এ কাজ।

এই সংবাদ জানতে পেরে কলম্বাস অবিলম্বে দেশে ফিরে যাওয়াই সমীচীন মনে করলেন। আড়াই বছর পরে ১৪৯৬ খ্রিঃ বছরের মাঝামাঝি সময়ে তিনি স্পেনে ফিরে এলেন। দেশে এবার তাঁর জন্য কোনও সম্বর্ধনার আয়োজন ছিল না।

রাতারাতি অবস্থার এমন অবনতি ঘটতে দেখেও মনোবল হারালেন না কলম্বাস। তাঁর বিশ্বাস ছিল, নবাবিষ্কৃত ভূখন্ড থেকে অফুরন্ত ধনসম্পদ তিনি আহরণ করতে পারবেন।

সেই বিশ্বাসেই অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে নতুন অভিযানের জন্য সম্রাটের সম্মতি আদায় করলেন। তারপর ১৪৯৮ সালের ৩০ মে তৃতীয় অভিযানে যাত্রা করলেন। এবারে নিজের পুত্র ও ভাইকেও সঙ্গী হিসাবে নিয়েছেন। হিস্পানিওয়ালায় পা দিয়েই কিন্তু স্থানীয় মানুষের বিদ্রোহের মুখে পড়তে হল কলম্বাসকে। নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালিয়ে এই বিদ্রোহ দমন করলেন তিনি। এই সংবাদ স্পেনে পৌঁছলে সম্রাট ফ্রান্সিসকো দ্য বোবদিলা নামে একজন রাজকর্মচারীর অধীনে একদল সৈন্য পাঠিয়ে দিলেন কলম্বাসের কাজের তদন্ত করতে।

বোবদিলা ইসাবেলা দ্বীপে পৌঁছে প্রথমে কলম্বাসের পুত্র ও ভাইকে বন্দী করলেন।

ক্রিস্টোফার কলম্বাস এর স্পেনে ফিরে আসা – Christopher Columbus Return to Spain :

হিস্পানিওলা দ্বীপে কলম্বাস তখন সর্বময় ক্ষমতায় আসীন। তথাপি বোবদিলার কাজে তিনি কোনও প্রকার বাধার সৃষ্টি করলেন না। সম্রাটের প্রতি আনুগত্যের সম্মান দেখিয়ে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করলেন। বন্দী করে তাঁকে নিয়ে আসা হল স্পেনে।

কলম্বাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হল, তাঁর নির্বুদ্ধিতার জন্য সম্রাটের প্রভূত পরিমাণ অর্থের অপচয় ঘটেছে। সোনা ও মূল্যবান মশলা আবিষ্কারের নামে তিনি সম্পদহীন দেশ আবিষ্কার করেছেন।

রানী ইসাবেলা কলম্বাসের প্রতি বরাবরই ছিলেন সহানুভূতিসম্পন্ন। এবারেও তাঁরই অনুগ্রহে কলম্বাস কারামুক্ত হলেন।

এই ঘটনা কলম্বাসের মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। সম্রাট ও রানীর কাছ থেকে যে সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন তা ফলপ্রসূ করে তুলতে পারেননি। একজন সফল অভিযাত্রী হিসেবে সমগ্র ইউরোপে যে সুখ্যাতি তিনি লাভ করেছিলেন, তারও মর্যাদা রক্ষা করতে পারেননি। ব্যর্থতা মানুষকে হতাশ নিষ্ক্রিয় করে দেয়। কিন্তু কলম্বাস ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া। অজেয় ছিল তাঁর মনোবল। তিনি কিন্তু ভেঙ্গে পড়লেন না। অদম্য সাহসে ভর করে চতুর্থ অভিযানের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করলেন।

ততদিনে শরীর তাঁর অনেকটাই কর্মক্ষমতা হারিয়েছে। বয়স পঞ্চাশের কোঠায়। তবুও গভীর আত্মবিশ্বাস নিয়ে উপস্থিত হলেন মহামান্য সম্রাটের দরবারে। চতুর্থবারের জন্য সমুদ্রযাত্রার আবেদন জানালেন। সৌভাগ্যক্রমে তাঁর আবেদন অগ্রাহ্য হল না। তবে, সম্রাট জানালেন, হিস্পানিওলাতে এদফায় যাওয়া চলবে না।

ক্রিস্টোফার কলম্বাস এর শেষ ও চতুর্থ অভিযান :

কলম্বাসের জাহাজ সমুদ্রে ভাসল। চতুর্থবারের অভিযান। সময়টা ১৫০২ খ্রিঃ ১৯শে মে।

কলম্বাস চলেছিলেন পশ্চিম দিকে। মাঝ পথে পড়লেন প্রবল ঝড়ের মুখে। বিধ্বস্ত জাহাজ নিয়ে আশ্রয় নিলেন এক অজানা দ্বীপে।

নাবিকদের অধিকাংশ জলে ভেসে গিয়েছিল। রসদের ভাঁড়ারেও ছোবল পড়েছিল ঝড়ের। তবুও অপরাজেয় কলম্বাসের মনোবল অটুট। তিনি বিশ্বাস করতেন, কাজই মানুষের জীবন।

যতক্ষণ পর্যন্ত দেহে প্রাণ থাকবে, অভীষ্ট পূরণের জন্য কাজ তাকে করে যেতে হবে। সমস্ত বাধা উপেক্ষা করে এগিয়ে যেতে হবে।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের এক দ্বীপে আশ্রয় নিয়েছিলেন কলম্বাস। সেখান থেকে ফিরে যান জামাইকা দ্বীপে। কঠোর পরিশ্রমে তাঁর শরীর ভেঙ্গে পড়তে লাগল । নতুন দেশের অজানা রোগে সঙ্গীদের অনেকেই মারা গেল।

সেই অবস্থাতেই দু বছর ধরে চেষ্টা চালিয়েও নিরাশ হলেন কলম্বাস। শূন্য হাতেই ফিরে এলেন দেশে।

মনের শান্তি হারিয়ে অশক্ত দেহে এরপর আরও দু বছর বেঁচেছিলেন কলম্বাস। শেষ জীবনে রাজানুগ্রহ থেকেও বঞ্চিত হয়েছিলেন তিনি।

ক্রিস্টোফার কলম্বাস এর মৃত্যু: Christopher Columbus’s Death

সেদিন নগদ সম্পদ তিনি সম্রাটের হাতে তুলে দিতে পারেননি। তাঁর আবিষ্কারের গুরুত্বও কেউ অনুধাবন করতে পারেননি। তাই লোকচক্ষুর অগোচরে ভ্যালাডোলিড শহরের এক সামান্য কুটিরে একজন নগণ্য মানুষের মতো কলম্বাসকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হয়েছিল। সময়টা ছিল ১৫০৩ খ্রিঃ।

ক্রিস্টোফার কলম্বাস কেন বিখ্যাত ছিলেন?

ক্রিস্টোফার কলম্বাস ছিলেন ইতালীয় নাবিক ও ঔপনিবেশিক।

কে কবে আমেরিকা আবিষ্কার করেন?

ক্রিস্টোফর কলম্বাস, আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কার করেন। ১৪৯২ সালে তিনি এই আবিষ্কার করেন।

কলম্বাস কবে সমুদ্রযাত্রা করেন?

ক্রিস্টোফার কলম্বাস (১৪৫১-১৫০৬) ইতালির বন্দর শহর জেনোয়া থেকে এসেছিলেন। তরুণ বয়সে তিনি সমুদ্রযাত্রা করেন।

কলম্বাস কোন দেশের নাবিক ছিলেন?

কলম্বাস জেনোয়া, ইতালী দেশের নাবিক ছিলেন।

Leave a Comment